Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Tourist Spots

সুইজারল্যান্ডের বরফঢাকা পাহাড়ে গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেসে

সুইজারল্যান্ড আমার কাছে চিরকালের এক স্বপ্নের দেশ। যে দেশে আছে বরফ ঘেরা উঁচু উচুঁ পাহাড়, সবুজ ঢালু আলপাইন উপত্যকা। আর সেই উপত্যকায় দাঁড়িয়ে ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’-এর মারিয়া গান গেয়ে ওঠে ‘পাহাড়গুলো আজ যেন জীবন্ত- সঙ্গীতের মূর্ছনায়’।

সেন্ট মর্টিজের সকাল।

সেন্ট মর্টিজের সকাল।

বিশ্বজিৎ সেন
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৭ ১৫:০৫
Share: Save:

জুরিখ বিমানবন্দরে প্লেন নামতেই মনটা নেচে উঠল। দূরে দেখা যাচ্ছে বরফছোয়া আল্প্স পর্বতমালা। তা হলে সত্যিই চলে এলাম পাহাড়ের দেশ সুইজারল্যান্ডে! জানুয়ারির শীতে সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি শুনে বন্ধুরা অবাক হয়েছিলেন। তবু চলেই এলাম। সুযোগ আর বেরিয়ে পড়ার নেশার এক সমন্বয়ের সদ্ব্যবহার আর কি!

সুইজারল্যান্ড আমার কাছে চিরকালের এক স্বপ্নের দেশ। যে দেশে আছে বরফ ঘেরা উঁচু উচুঁ পাহাড়, সবুজ ঢালু আলপাইন উপত্যকা। আর সেই উপত্যকায় দাঁড়িয়ে ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’-এর মারিয়া গান গেয়ে ওঠে ‘পাহাড়গুলো আজ যেন জীবন্ত- সঙ্গীতের মূর্ছনায়’। যদিও মারিয়া গান গেয়েছিলেন পাশের দেশ অস্ট্রিয়াতে দাঁড়িয়ে। তবু সেও তো এই পাহাড়ি অ্যালপাইন অঞ্চলেই।

শুনেছিলাম সুইজারল্যান্ডে ট্রেন দেখে লোকে নাকি ঘড়ি মেলায়। এ বার সেটা আমি নিজেও পরীক্ষা করে নিলাম। টাইমটেবলের সময় ধরে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিটে জুরিখ এইচবি স্টেশন থেকে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ি শহর সেন্ট মর্টিজে। ছোট্ট পাহাড়ি শহর সেন্ট মর্টিজ এ দেশের স্কি রিসর্টের অন্যতম। ১৯২৮ এবং ১৯৪৮ সালে এই শহরে শীতকালের অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের অবশ্য এই শহরে আসার একটাই কারণ, এই শহর থেকেই আমরা পরের দিন রওনা হব ‘গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেস’ ট্রেনে চেপে। জানুয়ারি মাসের দুপুরে সেন্ট মর্টিজ শহর কেমন যেন ঘুমন্ত। উঁচু-নিচু প্রধান সড়ক। দূরে দেখা যাচ্ছে পিজ বার্নিনা পাহাড়। হোটেলে পৌঁছে মেজাজও একটু নড়েচড়ে উঠল। পাঁচতারকা হোটেলের থেকেও বেশি ঘরের ভাড়া, অথচ না আছে ঘরে কফি মেকার, না আছে রুম সার্ভিস। লাগোয়া রেস্তোরাঁ তো দূরের কথা। অবশ্য মন ভরে গেল পরের দিন ভোরের সকালে যখন জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম সেন্ট মর্টিজের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। লেকের পাশে বরফে ঢাকা পাহাড়ের কোলে সূর্যোদয়ের পূর্বাভাসের লাল আলো। ব্রেকফাস্টের সময় হোটেল মালকিন নিজে এসে সঙ্গে বসলেন। অনেক ক্ষণ ধরে আন্তরিক ভাবে গল্প করলেন।


গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেসের যাত্রা শুরু হল সেন্ট মর্টিজ থেকে।

ভোর থাকতে থাকতেই এক সময় গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেসের যাত্রা শুরু হল সেন্ট মর্টিজ থেকে। সাদা বরফে ঢাকা আল্প্স পর্বতমালার অন্দরমহল দিয়ে গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেস চেপে আমাদের ভ্রমণ প্রায় আট ঘণ্টার। যার শেষে আমরা পৌঁছে যাব জার্মাট নামের আর এক পাহাড়ি শহরে। স্বচ্ছ কাচে মোড়া ফার্স্ট ক্লাস কামরায় যাত্রী বলতে এই মুহূর্তে শুধু আমি, আমার স্ত্রী এবং আমাদের আঠারো বছর বয়সের ছেলে। পুরো কামরাটাই যেন আমাদের। শীতের দেশে বেড়াতে আসার সুবিধেও যে কিছু আছে, এ যেন তারই এক প্রমাণ। শান্ত গতিতে ট্রেন এগিয়ে চলল বরফে ঢাকা সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তের দিকে। আমেরিকায় বহু দিন বসবাস করে বরফে ঢাকা প্রকৃতি আমাদের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। তবু গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেসের এই ভ্রমণ ভিন্ন এক স্বাদের। ন্যারো গেজ ট্রেনে যেতে যেতে এ যেন প্রকৃতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরা আর জড়িয়ে ধরে থেকে তার হৃদয়ের স্পন্দনকে অনুভব করা। পাহাড়, নদী সব যেন এক নিমেষে ট্রেনের জানলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে খেলার সাথী হতে।


পাহাড়, নদী সব যেন এক নিমেষে ট্রেনের জানলার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে খেলার সাথী হতে।

‘আলবুলা’ টানেলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে ‘ফিলিসুর’ শহর পেরিয়ে একসময় ট্রেন এসে দাঁড়াল পাহাড় ঘেরা, পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকা ‘চুর’ নামের এক শহরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার শুরু হল যাত্রা। ট্রেন এ বার এগিয়ে যাবে আরও বেশি উচ্চতার দিকে। প্রায় সাত হাজার ফুট উঁচুতে ‘ওবারআলপ্স’ পাস পেরিয়ে পৌঁছে যাবে মধ্য সুইজারল্যান্ডের আর এক পাহাড়ঘেরা শহরে, যার নাম ‘আন্ডারমাট’।

আরও পড়ুন: লাচুং-ইয়ুমথাং-লাচেন-গুরুদোংমার

এক সময় সকাল গড়িয়ে দুপুর এসে পড়ল। মেনু কার্ড দেখে আমরা ভাবছি কী খাবার অর্ডার দেব। এমন সময় ওয়েটার এসে বলল, ‘‘তোমরা যদি চাও তা হলে আমি তোমাদের বাসমতি রাইস আর চিকেন কারি বানিয়ে দিতে পারি।” সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিলাম সেই প্রস্তাব। বরফে ঢাকা আল্পস পাহাড়ের কোলে ট্রেনে যেতে যেতে সুইস শেফের রান্না করা ভারতীয় খাবারের আস্বাদ! এত প্রায় উপন্যাস লেখা! অবশ্য শেষ পর্যন্ত রান্নায় যে খুব একটা দক্ষতার ছোঁওয়া পাওয়া গিয়েছিল তা কিন্তু নয়। তবু ভাল লেগেছিল। মনের মণিকোঠায় স্থান পেয়ে গিয়েছে সেই সুন্দর অনুভূতির স্মৃতি।


শান্ত গতিতে ট্রেন এগিয়ে চলল বরফে ঢাকা সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তের দিকে।

আন্ডারমাট শহর ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই একসময় শুরু হয়ে গেল তুষারপাত। সামনেই কাঞ্চনজঙ্গার মতো উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়। তার সঙ্গে ট্রেনের পরিষ্কার স্বচ্ছ জানলা আর উপরে পরিষ্কার স্বচ্ছ ছাদের গা ঘেঁষে তুষারের শ্রাবণধারা। আকাশ পাহাড় প্রকৃতি এখন সৃষ্টির তুলির আদরে একেবারে ধবধবে সাদা রঙের। মেঘলা আকাশ, উঁচু-নিচু পাহাড় আর ঢালু উপত্যকার আড়ালে আবডালে চলছে আলোছায়ার লুকোচুরি।

গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেসের জানলার পাশে বসে অনেকক্ষণ ধরে অনুভব করলাম এই পরাবাস্তব দৃশ্য। ভাবতে চেষ্টা করলাম, সৃষ্টির কোটি কোটি বছরের বিভিন্ন স্তরের বিবর্তনে তৈরি হয়েছে প্রকৃতি, তার পর বিকশিত হয়েছে মানুষের চেতনা। সেই চেতনার ব্যাপ্তিতে এসেছে বিজ্ঞান। কোটি কোটি বছরের এই বিবর্তন এবং মানুষের চেতনার অভিব্যক্তির মিশ্রণ আজ আমাকে উপহার দিয়ে গেল ভীষণ দামি এক মুহূর্ত। গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেসের আধুনিক উষ্ণ পরিবেশে কেদারায় বসে স্বচ্ছ কাচের বড় জানলা আর ছাদের ভেতর দিয়ে এই তুষারপাতের দৃশ্য দিয়ে আমার স্মৃতির ব্যাঙ্কে তৈরি হল একটা ভীষণ দামি ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট।


একসময় তুষারপাত শেষ হল। আমাদের গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেস আস্তে আস্তে নেমে আসছে উঁচু পাহাড় থেকে।

একসময় তুষারপাত শেষ হল। আমাদের গ্লেসিয়ার্স এক্সপ্রেস আস্তে আস্তে নেমে আসছে উঁচু পাহাড় থেকে। একসময় এসে পৌঁছলো ব্রিগস নামের এক শহরে। স্টেশনের কাছেই বেশ উঁচু পাহাড়, একপাশে ঝকঝকে সুন্দর কিছু ফ্ল্যাটবাড়ি। মনে মনে ভেবে নিলাম রিটায়ার করে অবশ্যই আসব এখানে মাঝে মাঝে। থাকব ওই ফ্ল্যাটবাড়ির কোনও একটায়। ব্রিগস ছাড়িয়ে ট্রেন আবার রওনা দিল। সূর্য পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে শীতের বিকেলে। পড়ন্ত বিকেলের গোধুলির আলোয় দূরে দেখা যাচ্ছে ম্যাটারহরন পাহাড়ের চূড়া। প্রায় আট ঘণ্টায় ৯১টি টানেল আর ছোট-বড় ২৯১টি সেতু পেরিয়ে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি আমাদের শেষ স্টেশন, সুইজারল্যান্ডের আর এক স্কি রিসর্ট জার্মাট শহরে।

ছবি: লেখক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE