Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Durga Puja Celebration

উত্তাল সমুদ্রের উচ্ছ্বাস আর গ্রামজীবনের চলমান ছবি

পুজো গেল তো কী হয়েছে! হাতে দু’-তিন দিনের ছুটি। নাগালে সাগরপাড়। ঝাউবন, নির্জনতা, স্নানের সঙ্গে মিলবে অখণ্ড নির্জনতা।

সপ্তাহান্তে ঘুরে আসুন তাজপুর থেকে।

সপ্তাহান্তে ঘুরে আসুন তাজপুর থেকে।

শান্তনু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:০০
Share: Save:

শোঁ শোঁ করে পাশ কাটিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। উফ, সে গতির বহর দেখলে পিলে চমকে যায়। দ্বিতীয় হুগলি সেতুর টোলপ্লাজা, ধূলাগড় পেরিয়ে চলেছি, গাড়ির গতির বহর কমল না। অনেকের গন্তব্য বোধহয় দিঘা। তবে আমি একটু বেপথু। হাতে ছুটি পেলেই অল্পচেনা ডেস্টিনেশনে ঢুঁ মেরে আসি। কাকভোরে রওনা দিলাম। মিশকালো মসৃণ পথ বেয়ে এগিয়ে চলা। মাঝে মেচেদায় ব্রেকফাস্ট। সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম নন্দকুমার মোড়। এখান থেকে কাঁথিগামী রাস্তা ধরলাম। কিছু ক্ষণের মধ্যে কাঁথিও চলে এলাম। এখান থেকে প্রায় ১০ কিমি। ঘনবসতি প্রায় পাতলা হয়ে এল। অধিকাংশ জেলেদের গ্রাম। বাঙালির রসনা তৃপ্তির খাতিরে এঁরাই কাকভোরে গভীর সাগরবেলা থেকে মাছ ধরে আনেন। আপাত নির্জন বিচের নাম, বগুরান।

গাড়ি রেখে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি। খানিক বাদেই নাকে এসে লাগল শুঁটকি মাছের গন্ধ। ঝাউয়ের বনে নোনা বাতাসের শনশন। সাদা বালির ঢিবি পেরোতেই এক অনন্য সাগরবেলার সঙ্গে দেখা। মোহময় নির্জন সাগরবেলায় শুধুই শান্ত ঢেউয়ের আসা যাওয়া। অনন্য এই সাগরবেলার নাম, জলপাই। নির্জন বালির বিচে সাগর কিনারে এসে দেখা মিলবে লাল কাঁকড়াদের। সাদা বালির বুকে লাল কাঁকড়াদের ছোটাছুটি দেখে মনে হল তারা যেন শহুরে মানুষদের মতো বাস, মেট্রো ধরবার তাড়া। সারি সারি নৌকা বাঁধা আছে, সাগর কিনারে। অজস্র ঝিনুক, সন্ন্যাসী কাঁকড়া আর প্রকৃতির অপার নির্জনতার সঙ্গে সময় কোথা দিয়ে চলে এল তা টের পেলাম না। দিনের আলো থাকতে থাকতে ফিরতে হবে। অল্পচেনা বগুরানকে বিদায় জানালাম। কাছেই দরিয়াপুর। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত। রয়েছে সুন্দর লাইটহাউস। সময় বড়ই বাড়ন্ত। যাওয়া হল না।

কাঁথি থেকে আবার চলার শুরু, এ বারের গন্তব্য তাজপুর। বালিসাই মোড় থেকে বাঁ দিকে ঢুকে পড়লাম। বেশ উঁচু রাস্তা। পথের দু’পাশে বিশাল বিশাল ভেড়ি। সেই ভেড়ির চারপাশে ম্যানগ্রোভ দেখতে পেলাম। মাঝে মাঝে সাগরের জল এখানে ঢুকে পড়ে। খানিক এগিয়ে মোড় থেকে বাঁয়ে মুড়। হঠাৎ দেখা মিলল ঝাউবনের। কিছুটা এগোতেই রাস্তার বাঁ দিকে তাকাতেই সারি সারি হোটেল। ঘন ঝাউবন আর মাঝে মাঝে কেয়াগাছের বাহার। অদ্ভুত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। হোটেলে লাগেজ রেখেই বেরিয়ে পড়লাম।

আরও পড়ুন: দিন সাতেকের ছুটি? তা হলে বন্য পরিবেশের মধ্যপ্রদেশ হোক অবসরের ঠিকানা​

বালি আর ঝাউবনের ও পারে হলদেটে বালির বিচ আর তার পর সমুদ্র। শান্ত সাগরবেলায় শুধু সফেন ঢেউয়ের আনাগোনা। সে সৈকত লাল কাঁকড়াদের দখলে থাকে। আগন্তুক, পর্যটকদের দেখে লুকোচুরি খেলায় মেতে ওঠে, এঁকেবেঁকে যে যার গর্তে ঢুকে পড়ে। মাঝে মাঝে তাদের লাল এন্টেনার মতো দুটো ইন্দ্রিয়কে সজাগ রেখে গর্ত থেকে উঁকি দেয়। তাদের চলা ফেরাতেও শৈল্পিক ছাপ লক্ষ্য করলাম। বালির উপর নানান আঁকিবুঁকি। অসাধারন।

এক ছুট্টে সাগরের জলে নেমে পড়লাম। গুটিগুটি পায়ে সফেন ঢেউ পায়ের পাতা ছুঁয়ে যায়। তাজা বাতাস মন জুড়িয়ে দেয়। দূরে জেলেদের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। আর ঘোলাটে আকাশের পানে চেয়ে দেখি, অপরূপ আলোর ঝলক, চলকে আসছে। আকাশে এক চিলতে চাঁদের রুপোলী আলোর আলপিন মিশেছে নির্জন সাগর বেলায়। বঙ্গোপসাগরের নোনা জলে, ভিজে শরীরে এসে জাপটে ধরে চুঁইয়ে পড়া চাঁদের আলো আর ঝিরঝিরে বাতাসে মাদকতায় মজে থাকা। সারা দিনের লম্বা জার্নির ক্লান্তি সবটাই নিমেষে উধাও হয়ে যায়। এই তরতাজা হতেই তাজপুরে আসা। আকাশে নীল চাঁদের আলো। দিনের শেষ আলোটুকু শুষে নিয়েছে। ভিড় পাতলা হয়ে আসছে। সাগরপারের দোকানীরাও তাঁদের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করছেন। তাজপুরের মায়াময় সাগরপাড় ছেড়ে এ বার রিসর্টে ফিরে এলাম। এটা ইলিশের মাস। তাই ডিনারে যে ইলিশ পর্ব থাকছে, রিসর্টে ঢুকে ম ম গন্ধেই টের পেয়েছিলাম। চাঁদনি রাতে মিষ্টি বাতাস, বুনো ফুলের গন্ধকে ছাপিয়ে আসছে সর্ষে ইলিশের সুবাস। রাত সাড়ে আটটায় ডিনার চলে এল। সরু বাসমতী চালের ভাত, বেগুন বাহার আর ইলিশের চমৎকার দু’টি পদ। ইলিশের পাতুরি আর সর্ষে ইলিশ। এমন মায়াবী রাতে সমুদ্র ধার ঘেঁষা আধো গ্রামে ইলিশ বাহার চিরকাল মনে থেকে যায়।

পর দিন ভোরে এক অসাধারণ সূর্যোদয়ের দেখা মিলল, তাজপুরের সৈকতে। জনাকয়েক মানুষ সেই স্বর্গীয় দৃশ্যের উপভোগ করলাম। তবে জোয়ার থাকার কারণে তাজপুরের সমুদ্র বেশ উত্তাল। এই অবস্থায় স্নান করা সমীচীন নয়, তাই স্নান করলাম না। এ বার চলে এলাম, মোহনায়। এখানে সাগর এসে মিশেছে নদীতে। এখানে স্নান করতে হলে, স্থানীয়দের পরামর্শ মেনে চলুন।

আরও পড়ুন: বাঙালির বিলেত পাড়ি​

এ বার তাজপুর-শঙ্করপুরগামী রাস্তায় চলে এলাম। এক অসাধারণ রাস্তা। এক দিকে সমুদ্রের উচ্ছ্বাস মাঝে বুক চিরেছে মিশকালো পিচ রাস্তা। ডান দিকে ছবি আঁকা গ্রাম। এক দিকে ঝোড়ো হাওয়া, উত্তাল সমুদ্রের উচ্ছ্বাস আর অন্য দিকে গ্রামজীবনের চলমান ছবি। তাজপুরের গা ঘেঁষা গ্রামের নাম, চাঁদপুর। সমুদ্রের আগ্রাসন ঠেকাতে সাগরপার বাঁধিয়ে সুসজ্জিত করার কাজ চলছে। বাঁধানো বিস্তৃত চাতাল। বহু দূর চলে গিয়েছে। এখানেই গড়ে উঠেছে মেরিন ড্রাইভ। নিরালায় বসে সমুদ্রকে উপভোগ করতে হলে তাজপুর থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বের নবনির্মিত এই মেরিন ড্রাইভে চলে আসুন। আদিগন্ত আকাশের নীচে বঙ্গোপসাগরের বিস্তার। পাগলপারা ঝোড়ো হাওয়া। মাঝে মাঝে ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। পাশেই গ্রামজীবনের চলমান ছবি, এক কথায় অনবদ্য। এই স্থান স্নানের পক্ষে এক্কেবারেই উপযুক্ত নয়।

এ বার চললাম, শঙ্করপুরের দিকে। খানিক মন খারাপ হয়ে গেল। সমুদ্রের পাড়ের ঝাউবনকে গ্রাস করছে উদ্যত সমুদ্র। ভাঙন ঠেকাতে নানান প্রয়াস। নির্জন সাগরবেলায় এখনও জেগে আছে ঝাউবন। সেই সাগরবেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানান রঙের ঝিনুক। সমুদ্রবিলাসীরা সব সময় সৈকতেই সময় কাটিয়ে দেন। কেউ ঝিনুক কুড়োয়, আবার কেউ সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে খেলায় মেতে রয়েছে। স্নান সেরে নিলাম। দিঘার মতো ভিড়ে ভরপুর নয়। তবে জোয়ারের সময় সমুদ্রে নামা উচিত নয়। শঙ্করপুরে লাঞ্চ সেরে, এখানকার মৎস্যবন্দর দেখে চললাম মন্দারমণির দিকে।

মন্দারমণি আরও এক পরিচিত সমুদ্রসৈকত। মাদার আর কেয়াগাছের ভিড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জেলেদের গ্রাম, নৌকা আর ১৩ কিমি লম্বা সৈকত। শক্তবালির বিচ। এখান থেকে নিউ জলদা গ্রাম দেখে আরও পুব পাড়ের নির্জনতার খোঁজে চলে এলাম দাদনপাত্রবাড়ের দিকে। সারি সারি জেলে নৌকা আর খড় ছাওয়া কুঁড়েঘর। বাংলার সাগরঘেঁষা গ্রামজীবন দেখে নিলাম। আবারও মন টানল তাজপুরের দিকে।

আরও পড়ুন: মোহময়ী অযোধ্যার হাতছানি

ফিরে এলাম তাজপুরের সেই ঝাউমোড়া,অপার নির্জনতার তাজপুরে। আকাশের পশ্চিমপাড় সেজে উঠেছে সূর্যাস্তের আড়ম্বরে। নীল আকাশের বুক বেয়ে সূর্য গেল পাটে। তার অনির্বচনীয় শোভা ছড়িয়ে। সে রূপের বাহার শব্দের উজানকেও ছাপিয়ে গেল। তাই শুধুই নিরালা তাজপুরের শোভায় বুঁদ হয়ে থাকা।

কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে ১৮৭ কিমি দূরে তাজপুর। বাসে এলে নেমে পরুন বালিসাই। সেখান থেকে ভ্যানোতে চলে আসুন তাজপুর।

মন্দারমণি আসতে হলে নামতে হবে, চাউলখোলা।

শঙ্করপুর নামতে হবে বাসে অথবা ট্রেনে নামতে হবে রামনগর।

কোথায় থাকবেন: তাজপুরে থাকার প্রচুর বেসরকারি হোটেল। তাজপুর রিট্রিট (৯০৫১১৬৬৫৬৩/৯৮৩০২৭১০৬৪) ভাড়া ১০০০-২,৫০০ টাকা। হোটেল স্বর্ণপুরী (৯৯৩২৬৯৬৮৪১) ভাড়া ১,০০০- ১,৫০০ টাকা। তাজপুর নেচার ক্যাম্প (৯৮৩১৭৬৫৩৬০) ভাড়া ১,৬০০-২,০০০ টাকা।

শঙ্করপুরে থাকার জন্য রয়েছে, বেনফিশের তটিনী ট্যুরিস্ট লজ (০৩২২০-২৬৪৫৭৭), কিনারা ট্যুরিস্ট লজ (২৬৪৫৭৭) ভাড়া ৭৫০-১,৫০০ টাকা। বেসরকারি হোটেলের মধ্যে অশোক হোটেল অ্যান্ড লজ (২৬৪২৭৫) ভাড়া ৫০০-১,৯০০ টাকা। বেলানিবাস (২৬৪৮৭১) ভাড়া ৬০০-১,৮০০ টাকা।

মন্দারমণিতে থাকার জন্য রয়েছে অনুত্রি বিচ রিসর্ট (৯৩৩১৪-২৮৬৮৭) ভাড়া ৩,০০০-৫,০০০ টাকা। নীল নির্জনে(৯৩৩০৮-৫৯৪৮১) ভাড়া ১,৫০০- ৩,৫০০ টাকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE