Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

অষ্টবিনায়কের টানে মুম্বই

ডাকছেন গণপতি বাপ্পা। চলুন ঘুরে বেড়াই মুম্বইয়ের অলিগলিডাকছেন গণপতি বাপ্পা। চলুন ঘুরে বেড়াই মুম্বইয়ের অলিগলি

ওঝারে বিগ্নেশ্বর মন্দিরের গণপতি। ছবি: লেখক।

ওঝারে বিগ্নেশ্বর মন্দিরের গণপতি। ছবি: লেখক।

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৭ ১৯:০০
Share: Save:

‘অষ্টবিনায়ক’ অর্থাত্ গণেশের আটটি ভিন্ন রূপের মন্দির মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে। ‘অষ্টবিনায়ক মন্দির দর্শন’ মরাঠা সমাজ তো বটেই, এমনকী ভিন রাজ্যবাসীর কাছেও অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। মন্দিরগুলি প্রধানত মহারাষ্ট্রের পুণে, রায়গড় ও আহমেদনগর তালুকের মধ্যেই অবস্থিত। মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলেও পৃথক অষ্টবিনায়ক গণেশ মূর্তিগুলি প্রত্যেকটিই ‘স্বয়ম্ভু’।

অনেক রূপেই তিনি লীলাময়। এই একদন্ত, লম্বোদর, বিঘ্নবিনাসী, গণেশ দেবতাকে বলা হয় ‘লর্ড অব সাকসেস’। সিদ্ধিদাতা গণেশ মরাঠাবাসীর ভারী প্রিয় দেবতা। গণেশকে মরাঠাবাসী আদর করে ডাকেন ‘গণপতি বাপ্পা’। ভাদ্র মাসের শুক্ল চতুর্থীতে শুরু হয় গণেশের জন্মোত্সব উদযাপন। দশ দিনের এই গণপতি উত্সব বা গণেশ চতুর্থী বা ‘বিনায়ক চতুর্থী’ শেষ হবে ভাদ্র মাসের শুক্ল চতুর্দশীতে। এই ক্ষণটিকে বলা হয় ‘অনন্ত চতুর্দশী’। মহারাষ্ট্রের আমজনতার উত্সব এই গণপতি উত্সব। মুম্বইয়ের অলিগলিতে ছোট-বড়-মাঝারি সব মাপেই রমরমা মহোত্সব এখন। চলুন, ঘুরে আসা যাক পবিত্র ‘অষ্টবিনায়ক মন্দির’ পরিক্রমায়— মোরগাঁও অঞ্চলে ‘মোরেশ্বর গণপতি’, রঞ্জনগাঁওয়ে ‘মহাগণপতি’ থেউরে ‘চিন্তামণি’, লেনাদ্রিতে ‘গিরিজাত্মক’ ওঝারে ‘বিঘ্নেশ্বর’, সিদ্ধিটেকে ‘সিদ্ধি বিনায়ক’, পালিতে ‘বালেশ্বর’ এবং মাহাদ-এ ‘বরদা বিনায়ক’।

মোরেশ্বর গণপতি

মোরেশ্বর বা ময়ূরেশ্বর মন্দির মোরগাঁওয়ে কার্মা নদীর কিনারে অবস্থিত। ভক্তদের বিশ্বাস, অষ্টবিনায়ক দর্শনযাত্রায় মোরেশ্বর গণপতি দর্শন না করলে পবিত্র যাত্রাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গণেশপুরাণ মতে ‘সিন্ধু’ নামে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ দৈত্যকে গণেশ এখানেই নিধন করেছিলেন। ময়ূরবাহন হয়ে তিনি এসেছিলেন। তাই তিনি ময়ূরেশ্বর বা মোরেশ্বর। প্রাচীন এই মন্দিরটির সঠিক স্থাপনকাল জানা যায়নি। তবে, মরাঠা পেশোয়াদের নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা যে ছিল, সেটি জানা যায়। উত্তরমুখী প্রবেশদ্বার। এগারো ধাপ সিঁড়ি উঠে নগরখানা অর্থাত্ বাদ্যঘর। ছয় ফুট উঁচু একটি ইঁদুর মূর্তি রয়েছে। চতুর্ভূজ গণেশ মূর্তি। দুই হাতে ‘পাশা’ ও ‘অঙ্কুশ’ এবং অন্য দুই হাতের একটিতে মোদক ও অন্যটি হাঁটুর উপরে রাখায় ভাদ্রপদ চতুর্থী ও মাঘ চতুর্থীতে বিশাল উত্সব হয়।

যাওয়া আসা: মুম্বই থেকে সড়কপথে দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার। রেলপথে পুণে স্টেশনে নেমে বাস বা গাড়িতে যাওয়া যায়।

সিদ্ধি বিনায়ক গণপতি

আহমেদনগরের সিদ্ধাটেক অঞ্চলে ভীমা নদীর উত্তরভাগে জঙ্গলে ঠাসা পাহাড়ি টিলার উপর অষ্টবিনায়ক মন্দিরের একটি। মৌদগল্য পুরাণে আছে, ভগবান ব্রহ্মা অতি আত্মগর্বে জগত্ সৃষ্টির কাজ শুরু করলেও নানা ত্রুটি ও বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হন। এ ছাড়াও ব্রহ্মার জগত্ সৃষ্টির সময় মধু ও কৈটভ নামে দুই সাঙ্ঘাতিক অসুরও বিরক্ত করছিল। ব্রহ্মা তখন কার্যসিদ্ধির জন্য এই স্থানে ‘ওম শ্রী সিদ্ধিদাতা গণেশায় নমঃ’ মন্ত্র আরাধনায় গণেশকে তুষ্ট করেন এবং জগত্ সৃষ্টির কাজে সাফল্যলাভ করেন।

ইনদওরের রানিমাতা অহলাবাঈ হোলকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তত্কালীন পেশোয়া সর্দার হরিপন্থ ফাড়কের উদ্যোগে মন্দিরটি নির্মিত হয়। তিন ফুট উঁচু পাথরের বেদীতে উপবিষ্ট স্বয়ম্ভু গণপতি। এখানে গণেশের শুঁড়টি ডানদিকে বাঁকানো। কথিত আছে দক্ষিণমুখী শুঁড়বিশিষ্ট গণেশ অধিক শক্তিমন্ত্র এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করাও যথেষ্ট কঠিন। সেই হেতু এটিকে ‘জাগ্রত ক্ষেত্র’ বলা হয়। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী এবং কালো পাথরে নির্মিত। মন্দিরের গর্ভগৃহটি ১৫ ফুট উঁচু এবং ১০ ফুট প্রশস্ত। সিদ্ধিবিনায়ক মূর্তিটির দুই পাশে বিষ্ণুর দ্বাররক্ষীদ্বয়, জয় এবং বিজয়ের ব্রোঞ্জের মূর্তিও রয়েছে।

ভাদ্রপদ ও মাঘ চতুর্থীতে জমজমাট উত্সব ও মেলা বসে এখানে। দূরদূরান্ত থেকে আসেন ভক্তের দল। বিজয়া দশমী এবং সোমাবতী অমাবস্যায়ও উত্সব হয় এখানে।

যাওয়া-আসা: মুম্বই থেকে দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার। রেলপথে দাউন্দ স্টেশনে নেমে মাত্র ১৬ কিলোমিটার অটোতে।

বরদা বিনায়ক

বরদা বিনায়ক, অর্থাত্ যিনি সবার মনোবাঞ্ছনা পূরণ করেন। সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে মন্দির। মন্দিরের পিছনে বাঁশে ছাওয়া দত্তাবেয় মন্দির। মন্দিরটি পূর্বমুখী। দুটি বৃহত্ প্রস্তর নির্মিত হাতির মূর্তি আছে। গণেশ মন্দিরের পশ্চিমপাড়ে একটি হ্রদ আছে ‘দিভাচে তালে’ অর্থাত্ ‘দেবতার হ্রদ’। ২৪ ফুট শিখরবিশিষ্ট মন্দিরটিতে অনন্তকাল জ্বলছে একটি তৈলপ্রদীপ। পাথরের বেদীতে আসীন পূর্বমুখী গণেশ এবং পাথরখোদিত ‘ঋদ্বি ও সিদ্ধি’। কথিত আছে, ১৬৯০ সালে ধন্তু পুরকারপ নামে এক ভক্ত স্থানীয় জলপথ থেকে স্বয়ম্ভু মূর্তিটি পান। ১৭২৫ সালে সুবেদার রামজী মহাদেও বিভলরকার মন্দির স্থাপন করেন। প্রতি বছর ‘সংকষ্টি চতুর্থী’তে বিশাল উত্সব হয়।

যাওয়া-আসা: মুম্বই থেকে মাত্র ৮৩ কিলোমিটার এবং নিকটবর্তী রেল স্টেশন কারজাট।

বালেশ্বর গণপতি

প্রতি দিন ভোরে পালি অঞ্চলের অষ্টবিনায়ক মন্দিরের আরও একটি বালেশ্বরের পাদদেশে সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়ে। কথিত, ত্রেতাযুগের বণিকশ্রেষ্ঠ কল্যাণ শেঠ দম্পতির ধর্মভীরু বালকপুত্র বল্লালের নামে মন্দিরটি বল্লালেশ্বর বা বালেশ্বর। পূর্বমুখী পাথরের মন্দির। বাইরের গর্ভগৃহটি ১২ ফুট উঁচু। গণেশবাহন ইঁদুরের পাথরের মূর্তি সেখানে। মূলমন্দিরটি আটটি স্তম্ভের উপর অবস্থিত। বালেশ্বর মূর্তিটি রৌপ্যনির্মিত তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আছেন। মূর্তির চোখ দুটি এবং নাভি হিরেখচিত। মন্দিরের পিছনে ধুন্ডি বিনায়ক মন্দির, সেখানেও আরাধ্য গণপতি।

যাওয়া-আসা: মুম্বই থেকে ৯৮ কিলোমিটার। কোঙ্কন রেলপথে পেন স্টেশন।

চিন্তামণি বিনায়ক

মুলা নদী ত্রিসীমানা ঘিরে রেখেছে। কদম্ব গাছের নীচে বিনায়ক মন্দিরটি প্রাচীনকালে স্থিত ছিল। স্থানটির নাম কদম্বপুর থেকে নতুন নাম হয়েছে থেউর। এখানে গণেশ ‘চিন্তামণি’ রূপে পূজিত। মন্দিরটি নির্মাণ করেন মোরায়া গোসাভির পুত্র ধরণীধর দেব। তারও ১০০ বছর পর পেশোয়া আমলে সভামণ্ডপটি নির্মিত হয়। প্রবেশদ্বার উত্তরমুখী। চিন্তামণি গনেশ মূর্তিটি পূর্বমুখী। কালো পাথরের একটি ফোয়ারা আছে হল ঘরটিতে। আছে বিষ্ণু, মহাদেব ও হনুমান মন্দিরও। মন্দিরের পিছনে পেশোয়া মাধবরাও শ্রীমন্তের পেশোয়াওয়ারা। প্রতি বছর গণেশ চতুর্থী ছাড়াও কার্তিক মাসে শ্রীমন্ত ও তাঁর স্ত্রী রামাবাঈ সাহবের মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়।

যাওয়া-আসা: মুম্বই থেকে ১৮৫ কিলোমিটার এবং পুণে থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার।

গিরিজাত্মক বিনায়ক

গণেশপুরাণে স্থানটির নামোল্লেখ আছে জীর্ণপুর বা লেখন পর্বত। জুথার অঞ্চলে পাহাড় টিলায় বৌদ্ধ গুম্ফার মাঝে একটি গুহায় গিরিজাত্মক গণেশ বিরাজমান। ২৮৩টি সিঁড়ি টপকে গুহার কাছে পৌঁছতে হয়। সিঁদুরমাখা গণপতি। ভক্তেরা কেবল গণেশমূর্তির পৃষ্ঠদেশ দেখতে পান। বলা হয়, বিপরীত পাহাড় টিলা থেকেই গণেশের সম্মুখভাগ দেখা যেতে পারে। তবে সেটি খুবই বিপজ্জনক। বিশেষত সেই পাহাড়ে মৌমাছির উত্পাত সাঙ্ঘাতিক। পাহাড় টিলায় হটকেশ্বর শিবমন্দিরটি ট্রেকার যাত্রীদের বেশ পছন্দের।

যাওয়া-আসা: মুম্বই থেকে ১৬১ সড়কপথে গুহা পর্যন্ত পৌঁছতে ঢুলির ব্যবস্থাও আছে।

বিঘ্নেশ্বর বিনায়ক

ওঝারে কুকারি নদীর তীরে বিঘ্নাসুর নামের পরাক্রমাশালী অসুরকে নিধন করেন, তাই বিঘ্নেশ্বর গণপতি। কথিত আছে মৃত্যুর পূর্বে বিঘ্নাসুর গণেশের কাছে ক্ষমা চান এবং গণেশ সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর নামের সঙ্গে নিজের নামটি রাখেন ‘বিঘ্নাহার’ বা ‘বিঘ্নেশ্বর’। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে প্রস্তর নির্মিত বিশাল দুই ‘দ্বারপাল’ রয়েছে। প্রশস্ত মন্দিরভবনটি উত্তর থেকে দক্ষিণ ব্যাপ্ত। প্রবেশপথে পাথরের ইঁদুর। গণেশের শুঁড় বাঁ দিকে এবং দামি পাথর ও রুবি দিয়ে দুই চোখ ও কপালে হীরেখচিত। মূর্তির দু’দিকে রুপোর দীপমালা প্রজ্জ্বলিত।

যাওয়া-আসা: মুম্বই থেকে ১৯১ কিলোমিটার। মুম্বই বা পুণে থেকে নারায়ণগাঁও হয়ে জুম্মার যেতে ওঝার এলাকা।

মহাগণপতি বিনায়ক

স্থানটির পূর্ব নাম ছিল মণিপুর। পরে নাম হয় রঞ্জনগাঁও। এখানেই গণেশের বরে স্বয়ং শিব বিপুরামুর দৈত্যকে বধ করেন। অষ্টবিনায়ক মন্দিরের একটি এই মহাগণপতি। মন্দিরটির গঠনশৈলী এমন যে সূর্যের দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ন পরিক্রমাকালে সূর্যরশ্মি সরাসরি দেবতার অঙ্গ স্পর্শ করে। প্রবেশদ্বারের দু’দিকে দুই দ্বারপাল। পাথরখোদাই। উপবিষ্ট পূর্বমুখী গণেশমূর্তি। চওড়া কপালে দামি পাথরখচিত। প্রতি ভাদ্রপদ চতুর্থীতে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। বিশ্বাস, গণপতিবাপ্পা কোনও আশা অপূর্ণ রাখেন না।

যাওয়া-আসা: মুম্বই থেকে ২১২ কিলোমিটার। পুণে-অওরঙ্গাবাদ হাইওয়েতে রঞ্জনগাঁও একটি বড় জনপদ।

প্যাকেজ ট্যুর

‘অষ্টবিনায়ক দর্শন’ এখন পিক সিজন। গণেশ চতুর্থী উত্সব উপলক্ষে ‘অষ্টবিনায়ক দর্শন’-এর জন্য বিভিন্ন ট্যুর প্যাকেজের ব্যবস্থা আছে। দুই দিন এক রাতের সময়সীমা থাকা-নিরামিষ আহার, নন এসি/এসি বাস, ট্যুর ম্যানেজার ও গাইডের ব্যবস্থা থাকে। ট্যুর-পিছু খরচ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মোটামুটি ৩৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা। শিশুদের জন্য একটু কম। অন্য সময় খানিকটা কম হয় যাত্রীসংখ্যার নিরিখে।

ছবি: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE