Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
Travel

দারিদ্রের শোকেস সাজিয়ে কম্বোডিয়ার ফ্লোটিং ভিলেজ

কোহ রং সামোলেম দ্বীপে এক পাবের ওয়েটার যুবকটির একমাত্র স্বপ্ন, বাবা-মাকে নিয়ে আঙ্কোরভাট মন্দির দেখতে যাবেন এক দিন। বিদেশিরা এসে দেখে যায়। অথচ তাঁদের কখনও দেখা হয় না। কারণ? সন্ধানে সুচন্দ্রা ঘটকপাশ দিয়ে এক নৌকো স্কুলফেরত পড়ুয়া। কেউ হাত নাড়ে। কেউ আবার ফিরেও তাকায় না, বন্ধুর আঁকার খাতা দেখতে ব্যস্ত। নিজেদের স্কুলফেরত পুলকারের আড্ডার কথায় মশগুল তখন বড় নৌকোটা। ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে পেরিয়ে যাচ্ছে ভাসমান স্কুল, সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক। বিদেশি পর্যটকদের নৌকোটা তখন ওই পড়ুয়াদের গাঁয়ের ভিতরে ঢোকার চেষ্টায় বেজায় জোরে পিছনের দিকে ঠেলে চলেছে কম্বোডিয়ার টোনলে সাপ লেকের জল। তার উপরেই ভাসমান গ্রামের নাম ক্যামপং ফ্লুক। লিখছেন সুচন্দ্রা ঘটক

সাদা বালি, নীল জলের মনোরম দৃশ্য কোহরঙ্গ সামুলেম দ্বীপে।

সাদা বালি, নীল জলের মনোরম দৃশ্য কোহরঙ্গ সামুলেম দ্বীপে।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ১৭:০৯
Share: Save:

পাশ দিয়ে এক-নৌকো স্কুলফেরত পড়ুয়া। কেউ হাত নাড়ে। কেউ আবার ফিরেও তাকায় না, বন্ধুর আঁকার খাতা দেখতে ব্যস্ত। নিজেদের স্কুলফেরত পুলকারের আড্ডার কথায় মশগুল তখন বড় নৌকোটা। ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে পেরিয়ে যাচ্ছে ভাসমান স্কুল, সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক। বিদেশি পর্যটকদের নৌকোটা তখন ওই পড়ুয়াদের গাঁয়ের ভিতরে ঢোকার চেষ্টায় বেজায় জোরে পিছনের দিকে ঠেলে চলেছে কম্বোডিয়ার টোনলে সাপ লেকের জল। তার উপরেই ভাসমান গ্রামের নাম ক্যামপং ফ্লুক।

ভ্রমণপ্রেমী শহুরে ভারতীয়দের বছরে দু’-একটা সপ্তাহান্ত কোনও না কোনও গ্রামে কেটেই থাকে। গ্রাম-জীবনের ভাল-মন্দ, চ্যালেঞ্জ নিয়ে আদিখ্যেতার চর্চা তাই এই নৌকোর কারও কাছেই নতুন নয়। সাত সকালে সিয়েম রিপের সাহেবি হোটেলে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট সেরে টুকটুকে (স্থানীয় এক রকমের গাড়ি) ওঠার আগে থেকেই সকলে নিজের নিজের মতো করে প্রস্তুত, গ্রাম অভিযানের জন্য। কী কী দেখতে হয়, কেমন ছবি তুলতে হয়, কোন সময়ে চোখ থেকে সানগ্লাসটা নামিয়ে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ সাজতে হয়— সবের সঙ্গে পরিচিত এই নৌকোর আরোহীরা। বিদেশের দারিদ্র দেখতেই তো বেশি টাকা দিয়ে এ দিন গাড়ি ভাড়া করেছে এই ভারতীয়রা।

কিছু আগেই আকাশছোঁয়া দাম হাঁকা কুমিরের চামড়ার ব্যাগের দোকানগুলো পেরিয়ে এসেছেন বিদেশিনিরা। নিঃশব্দে সঙ্গীদের চোখের আড়াল করে ফেলেছেন দীর্ঘশ্বাস। সে সব জিনিস হাতে ঝোলাতে না পারার দুঃখ হয়তো বা ঘুচিয়ে দেবে ভাসমান গ্রামের দুখিনি মা-মেয়েরা। মোটরে টানা টুকটুক শহুরে পিচগলা রাস্তা ছাড়িয়ে ইতিমধ্যে তাঁদের টেনে নিয়ে গিয়েছে ধান খেতের মাঝের রাস্তায়। আরও একটু এগিয়ে কোরিয়ান রিং রোড ছাড়িয়ে, তাঁরা দেখে নিয়েছেন বিভিন্ন দেশের দানের টাকায় তৈরি হওয়া পিচ রাস্তা একটু দূরে গিয়েই নেমে যায় মেঠো পথে। টুকটুক কাদা-মাটিতে আটকাতে শুরু করে। মাঝেমধ্যেই গাড়ি থেকে নেমে পায়ে পায়ে ভাসমান গ্রামের উদ্দেশে নিজেকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। তখন কে-ই বা জানতেন সামনে অপেক্ষারত আরও কত চমক! তখনও জানা নেই কতটা গোলমাল হয়ে যেতে পারে এত কাল ধরে শিখে আসা হিসেব নিকেশে।

হিসেবিপনায় প্রথম ধাক্কা দেয় চার জনের প্রবেশমূল্য ৮০ মার্কিন ডলারের দক্ষিণা। গ্রাম দেখার জন্য এত মূল্য দেওয়ার অভ্যাস নেই এঁদের। নিজেদের দেশে গ্রাম মানেই তো কম খরচে ভ্রমণ!

ইতিমধ্যে দেখা হয়ে গিয়েছে স্বপ্নের আঙ্কোরভাট। সাদা চামড়ার পর্যটকদের ভিড় দেখে কোনও টিকিটই অতিরিক্ত দামি মনে হয়নি এত দিন। বিশ্বখ্যাত ঐতিহ্য যে এত দামেই বিকোয়! কিন্তু তাই বলে গ্রামের নৌকোর ভাড়া মার্কিন ডলারে!

আঙ্কোর চত্বরে মুগ্ধ করেছে এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য। কিন্তু মন্দির ঘুরছেন শুধু বিদেশি পর্যটকেরাই। ক’জন স্থানীয় পর্যটককে দেখা গেল গোটা বারো দিনের ভ্রমণে? মনে হয়েছে, তবে ভাবনাকে বশ করে নেয় মুগ্ধতা। এক সময়ে যে দেশ এমন রাজকীয় ছিল এখন তাদের কিসসু নেই কেন, করা হয় না সে প্রশ্ন। সমবয়সী এক তরুণী কোলে সন্তান নিয়ে পাশে এসে চড়া দামে হাতে তৈরি স্কার্ফ বেচতে এসেছিলেন। কিনতে ইচ্ছে হয়নি। দাম শুনেই কপালে চোখ! ওঁর কাছে জানতে চাওয়ার সাহস হয়নি, কোলের শিশুকন্যাকে নিয়ে কখনও বেড়াতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন কি না? হঠাৎ মনে পড়ে যায় কোহ রং সামোলেম দ্বীপে এক পাবের ওয়েটার যুবকটির কথা। তাঁর একমাত্র স্বপ্ন, বাবা-মাকে নিয়ে আঙ্কোর মন্দির দেখতে যাবেন এক দিন। বিদেশিরা এসে দেখে যায়। অথচ তাঁদের কখনও দেখা হয় না। কারণ? যথেষ্ট টাকাই জমে না। পড়াশোনাই করা হয়নি যে। কম্বোডিয়ার একমাত্র পর্যটকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ওই দ্বীপে যাওয়ার পথে পার্টি বোটে। একটু কথা হতেই জানা গেল, বেড়াতে আসেননি ওই যুবক। বিদেশি বস-কে এক দিনের জন্য সঙ্গ দিতে এসেছেন ইন্টারপ্রেটার হয়ে।

হিসেব গোলমাল হতে হতেই নৌকো ঢুকে গিয়েছে ভাসমান গ্রামের ভিতরে। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে ঘেরা এই জল-বসতি অঞ্চলের সঙ্গে ইতালির ভেনিসের কোনও মিল নেই। ভারতীয় গ্রামীণ রাস্তার মতো এখানকার জলপথেও ময়লা-বর্জ্য ছড়িয়ে। আরও একটু দূরে আসল নদীটা। যেখান থেকে জল উপচে প্রথম ভাসতে শুরু করেছিল এই বসতি অঞ্চল। সেখানে স্বচ্ছ জল আছে।

আরও একটা বাঁক নিল জলপথ। পথের দু’ধারে মাচার উপর পর পর ঘরবাড়ি। সামনে নৌকো বাঁধা। ভাসমান রেস্তোরাঁয় হঠাৎ থামল নৌকো। মাচা পেয়ে ও পারে যেতেই ডিঙি নৌকোর পসরা। গ্রামের অলিগলি ঘুরতে গেলে উঠে বসতে হবে গ্রামের মহিলাদের চালানো ওই ডিঙিতেই। বড় যান ঢোকে না যে সরু গ্রাম্য গলিতে।


ভাসমান গ্রামে
যাওয়ার পথে।


পোলপটে ‘কিলিং ফিল্ড’ এর
আলমারিতে সাজানো মানুষের খুলি।

রঙিন জামা, মাথায় মানানসই টুপি, কোলে বছর দুয়েকের শিশুকন্যাকে নিয়ে বৈঠে হাতে বসে আছেন তরুণী। নেমে যেতে হল তাঁর ডিঙিতে। ভ্রমণ শেষে মাথা পিছু ৮ মার্কিন ডলার করে তুলে দিতে হবে তাঁর হাতেও। পাশের নৌকোয় বসা ভারতীয় বান্ধবীর অবাক উক্তি, “ভাবা যায়, এঁরাও ডলারে কামায়!”

আঁকাবাকা জল-রাস্তায় ভাসতে শুরু করল সুন্দরীর ডিঙি। বান্ধবীর মন্তব্য তখনও কানে ভাসছে। কিন্তু এত ডলার যায় কোথায়! প্রতিটি গলি তো দারিদ্রের শোকেস! ডলার আসে, কিন্তু থাকে না। এই জলপথেই হয়তো কোথাও একটা চলে যায়। ফ্লোটিং ভিলেজ তাই তৃতীয় বিশ্বের ভেনিস হয়ে ওঠে না। আসল রূপ ধরে রাখে। দারিদ্র বিকোয় মার্কিন ডলারে। সে জন্যই তো বিদেশিরা দেখতে আসে। বাড়ি ফিরে ব্লগে ভরিয়ে দেয় ইন্টারনেট। আরও লোকে জানতে পারে। দেখতে যায়। আরও ডলার বয়ে যায় জলপথের এখানে ওখানে।

সে ডলার কি জমা হয় সিয়েপ রিপ শহরের সৌন্দর্যায়নে? পাব স্ট্রিট, নাইট মার্কেটের সাজ কি তাতেই হয় আরও জমজমাট? দিনভর খাটুনির ভ্রমণ শেষে বিদেশিদের ফুর্তির মতো জায়গাও তো করে দিয়েছে এই দেশ। নানা ভাবনা ঘুরপাক খায়। আলোচনা হয় ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের মধ্যে সরু জলীয় গলি দিয়ে ভাসতে ভাসতে। ফিরে গিয়ে নাইট মার্কেট থেকে কম দামে স্টাইলিশ জামাকাপড়, অথবা পাব স্ট্রিটে বিফ লোক লাক ভাল করে দেবে মন। চিন্তার ভার থেকে মুক্তি দেবে। কম্বোডিয়া ছাড়ার আগে আবার ঘুরে আসা যায় কি বায়অনের সামনে থেকে। অথবা পূর্ণিমার চাঁদের তলার আঙ্কোরভাট দেখে আসব আর এক বার। মন ভাল হয়ে যাবে। মেলাতে হবে না হিসেব। ভাবতে হবে না বড় নৌকোটায় ওঠার সময়ে যে সাপভাজাগুলো বিক্রি হচ্ছিল রাস্তার ধারের জুয়ার ঠেকে, স্কুল ফেরত বাচ্চারাও কি টিফিনের পয়সা জমিয়ে সেখানেই যায়?

নম পেন-এ পল পটের অত্যাচারের নিদর্শন দেখার পরেও তো পরের দিনগুলো আনন্দেই কাটাতে পেরেছে এ তরুণী। কোহরং সামোলেম আইল্যান্ডে গিয়ে ঝলমলে সূর্যের আলোয় সাদা বালি, নীল জলের উন্মাদনার মাঝে কত বারই বা মনে পড়েছিল কঙ্কালে সাজানো কাচের বহুতলটার কথা? এ বারও ঠিক উতরে যাবে মনখারাপ। হঠাৎ গল্পের ফাঁকে উঠে এল জমজমাট পাব স্ট্রিটে মাত্র দেড় ডলারে লং আইল্যান্ড আইস টি। হ্যাপি আওয়ারের মধ্যেই চটজলদি ফিরে যেতে হবে এ গ্রাম থেকে। না হলে মাঠেমারা যাবে সন্ধেটা।

পর্যটকদের এ ভাবে মন ভার করে ফেরাও যে বেড়ানোর অঙ্গ। মাঝেমাঝে উদাস না হলে কী আর সিরিয়াস ট্যুরিজম হয়! দেশে ফিরে তবে গল্প করবে কী?

কী ভাবে যাবেন?

বিশ্বের যে কোনও প্রান্ত থেকে উড়ানে ব্যাঙ্কক। সেখান থেকে কম্বোডিয়া যাওয়ার উড়ান মিলবে। নামতে হবে নম পেন বিমানবন্দরে। হোচিমিন সিটি, হং কং, কুয়ালা লামপুর, সিঙ্গাপুর থেকেও বিমানে পৌঁছনো যায় নম পেন। তাইল্যান্ড থেকে কম্বোডিয়া যাওয়া যায় সড়ক পথে, পয়পে সীমান্ত পেরিয়ে।

কোন সময়ে যাবেন

ক্রান্তীয় আবহাওয়া। সারা বছরই তাপমাত্রা থাকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে আদ্রতা কম থাকে। কম্বোডিয়া বেড়ানোর জন্য তাই এই সময়টাই বেশি জনপ্রিয়।

দশটি প্রধান আকর্ষণ

• আঙ্কোরভাট
• বান্টে শ্রেই
• সিয়েম রিপ শহর
• ক্যামপং ফ্লুক গ্রাম (ফ্লোটিং ভিলেজ)
• নম পেন
• সিহানুুক ভিল শহর
• কোহ রং সামোলেম আইল্যান্ড
• বকোর হিল স্টেশন
• রোটানাকিরি
• ক্যাম্পট

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE