Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মধ্যরাতে সূর্যের হাত ধরে ঘোরাঘুরি

কলকাতা থেকে প্রথম বার ইউরোপ এসেছিলাম মেয়ে মুনুয়ার কাছে। তার তখন নতুন সংসার। সে সব কেমন সামলাচ্ছে, তাই দেখতেই সে বার এসেছিলাম। পাশাপাশি ফ্রান্সের প্যারিস, ইতালির পিসা আর জার্মানির অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত মিউনিখ-সহ ব্যাভেরিয়ার বিভিন্ন শহর ঘুরেছিলাম। এ বার মূলত ঘোরার উদ্দেশ্যেই ইউরোপ আসা। ভ্রমণসূচিতে রয়েছে সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ইতালি, সুইৎজারল্যান্ড, জার্মানি ও লুক্সেমবার্গ।

অপেরার সামনে কাচের তৈরি ছোট জলযান।

অপেরার সামনে কাচের তৈরি ছোট জলযান।

শিখা রায়
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

কলকাতা থেকে প্রথম বার ইউরোপ এসেছিলাম মেয়ে মুনুয়ার কাছে। তার তখন নতুন সংসার। সে সব কেমন সামলাচ্ছে, তাই দেখতেই সে বার এসেছিলাম। পাশাপাশি ফ্রান্সের প্যারিস, ইতালির পিসা আর জার্মানির অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত মিউনিখ-সহ ব্যাভেরিয়ার বিভিন্ন শহর ঘুরেছিলাম। এ বার মূলত ঘোরার উদ্দেশ্যেই ইউরোপ আসা। ভ্রমণসূচিতে রয়েছে সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ইতালি, সুইৎজারল্যান্ড, জার্মানি ও লুক্সেমবার্গ।

কাতার এয়ারলাইন্সের বিমানে এক ভোরবেলায় কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলাম দোহার উদ্দেশে। দোহায় উড়ান পাল্টে প্রায় ১৫ ঘণ্টা সফর করে পৌঁছই ডেনমার্কের কোপেনহাগেনে। সেখান থেকে ঘণ্টা তিনেক ট্রেনে চেপে সুইডেনের গোথেনবার্গ। নামলাম যখন রাত তখন প্রায় ৯টা। অথচ অন্ধকারের লেশ মাত্র নেই!

গোথেনবার্গ শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটি নদী। পর দিন বিকেলে মুনুয়া এবং কিরণের সঙ্গে আমরা গেলাম সেই নদীতে ছোট স্টিমারে চেপে জলভ্রমণে। কিরণ আমাদের জামাই। নদী ঘুরে গেলাম গটগটিতে, এখানকার সবচেয়ে বড় চকোলেটের দোকান। সেখান থেকে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সেই রাত ৯টা। আকাশে তখনও গনগনে রোদ্দুর। রাতের খাবার খেয়েদেয়ে উঠলাম যখন, ঘড়িতে তখন প্রায় ১১টা। অন্ধকার তখনও নামেনি।


অপূর্ব ফিয়র্ড

দু’দিন পর কিরণ এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে গেল নরওয়ের উত্তর প্রান্তে ট্রমসো শহরে। সেখানে পৌঁছে উচ্ছ্বসিত হয়ে সে জানাল, ট্রমসোতে মধ্যরাতেও আকাশে সূর্য উপস্থিত। পর দিন মধ্যরাতের সূর্যের কল্যাণে এখানে অনুষ্ঠিত হল ‘মিড সামার ডে’। গান-বাজনা-খানা-পিনার সঙ্গে চলল ‘মিড সামার পোল’— ফুল-পাতায় সাজানো এক স্তম্ভের উত্তোলন পর্ব। যদিও স্থানীদের মুখে সারা ক্ষণ একটাই কথা, আকাশে মেঘ থাকবেই। কাজেই রাতের সূর্য যে মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকবে সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত।

এর পর দিন রাতে নিল এরিকসন টার্মিনাল থেকে আমরা বাসে চেপে রওনা দিলাম অসলোর উদ্দেশে। অসলো নরওয়ের রাজধানী। রাতের আকাশে মেঘ রয়েছে। চার দিক যেন মেঘে ঢাকা গোধূলি বেলার মতো! সওয়া তিন ঘণ্টা ধরে পেরোলাম প্রায় সাড়ে ৩০০ কিলোমিটার রাস্তা। বাসে দু’তিন বার লোকজন ওঠানামা করল। আর আমি দেখতে দেখতে চললাম, আকাশে কখনও সূর্যের উজ্জ্বল উপস্থিতি, কখনও বা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তার সৌন্দর্য। তবে, চলমান বাসে বসে তার অস্ত না উদয়, কিছুই বুঝতে পারলাম না।

অসলো বাস স্ট্যান্ডে যখন নামলাম, সময়টাকে মোটেও ভোর বলা যাবে না! কিন্তু, এদের তো ঘুমের সময়। দু’একটা দোকান ছাড়া অফিস, পর্যটন অনুসন্ধান অফিস সবই বন্ধ। কাজেই আমরা সারা দিনের ঘোরার প্রস্তুতি নিয়ে শহর বেড়ানোর টিকিট কাটার অপেক্ষা করতে লাগলাম। সাতটা নাগাদ মিলল সেই টিকিট। কিন্তু, অনুসন্ধান অফিস খুলবে তো সেই আটটার পর! সেই ফাঁকে শহরের কোনও একটা দিক থেকে এক পাক দিয়ে আসব বলে চেপে বসলাম ট্রামে।


কলসপত্রী

ইউরোপের শহরগুলিতে আঞ্চলিক সব পরিবহণ সারা দিন ব্যবহারের জন্য টিকিট পাওয়া যায়। জার্মানিতে ট্রেন, বাস, ট্রাম, মেট্রো, মিউনিখে ইউ-ভ্যান— সব কিছুতেই চড়েছি ওই টিকিটে। অসলোতে এর সঙ্গে আছে ফেরিও। কিছুটা ঘুরে বুঝতে পারলাম, অনুসন্ধান অফিসের আর দরকার নেই। অনেক কিছু হেঁটেই দেখা যাবে। আর একটু দূরে গেলে বাস বা ট্রামের ম্যাপই যথেষ্ট। কাজেই আটটার মধ্যে পার্লামেন্ট ভবনে বাইরেটা, দুটো কনসার্ট হল, এমনকী একটা পার্কের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে গেলাম সিটি সেন্টারে।

শহরের মাঝে নদীর ধারে অপূর্ব স্থাপত্যের চার্চ দেখে চলে গেলাম নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় যেখান থেকে সেই ভবনটির কাছে। তখনও সেটি খোলেনি। সমুদ্রের ধারে জাহাজ ও নানা ধরনের ফুল দেখতে দেখতে এগোলাম। তার মধ্যে কলসপত্রী রয়েছে দেখলাম। আমরা গিয়ে বসলাম একটা পার্কের মধ্যে। বাড়ি থেকে আনা প্রাতঃরাশের কৌটো খোলা হল। মেয়ে-জামাই যে এত রন্ধনপটু ও ভোজনবিলাসী হয়ে উঠল কী ভাবে তা দেখে অবাক হচ্ছি! অথচ দু’জনেই পদার্থবিদ্যার কোন এক দুরুহ বিষয় নিয়ে গবেষণার কাজ করে।

দুটো অল্প বয়সী ছেলের সঙ্গে পরিচয় হল। ওরাও বেড়াতে বেরিয়েছে। নিজে থেকেই আমাদের অসলো শহরের ম্যাপ দিয়ে ওরা বুঝিয়ে দিল কী ভাবে কম সময়ের মধ্যে অনেকটা ঘোরা যাবে।

খাবার খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। অথচ পকেটে রয়েছে প্রচুর দাম দিয়ে কেনা চার জনের টিকিট। প্রথমে গেলাম ‘অপেরা’ নামে একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার দেখতে। তার স্থাপত্য, আয়তন এবং পরিবেশ যে কোনও পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয়। অপেরার ঠিক সামনে কাচের তৈরি একটা ছোট জলযান এমন ভাবে রাখা আছে যেন মনে হচ্ছে, ওটা কাত হয়ে সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে।


স্কাল্পচার্স পার্ক

ট্রামে করে ফিরে এলাম সিটি সেন্টারে। সেখান থেকে গেলাম স্কাল্পচার্স পার্কের দিকে। শয়ে শয়ে বিভিন্ন বয়সের নরনারীর মূর্তি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বিশাল এলাকা জুড়ে সাজানো রয়েছে। কোনও মূর্তির গায়ে এক টুকরো সুতো পর্যন্ত নেই। দেহের প্রতিটি ভঙ্গিমা নিখুঁত ও নিটোল। দেখেই সে সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কে, কী ভাবে, কেন তৈরি করেছে এই শিল্প— তার খোঁজ নিতেই ভুলে গেলাম। প্রায় দুটো বেজে গেল। যেতে হবে শান্তি ভবন। তার আগে ওই পার্কের কাছের ঘন ছায়ায় বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম আমরা।

মিনিট ১৫ পরে ট্রামে করে গেলাম সেখানে, যেখানে প্রতি বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। সাধারণত সময় কম থাকলে এবং উপযুক্ত গাইড না পেলে মূলত ভাষার সমস্যার জন্যই মিউজিয়াম দেখার আগ্রহ থাকে না! কিন্তু, এটা দেখার লোভ সামলানো গেল না। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে একটা ব্যাপার জেনে আশ্চর্য হলাম— ১৯৪৮ সালে গাঁধীজি এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর জন্য সে বছর কাউকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়নি। মহম্মদ ইউনুসের সক্রিয়তায় এখানে বাংলাদেশের তৈরি অনেক হস্ত শিল্প সামগ্রী আছে। যেগুলোর গায়ে বাংলা হরফ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। আমাদের অনুভূতিতে তখন বিকেল, কিন্তু সূর্য তো মধ্য গগনে!

রওনা হলাম জলপথ ভ্রমণের উদ্দেশে। এখানে জনপ্রিয় ও সুবিধাজনক পরিবহণ ব্যবস্থা এটি। পর্যটকদের উপযোগী ছোট জাহাজ পাহাড়ের ধার ঘেঁষে চলল ফিয়র্ডের সৌন্দর্য দেখাতে। সমুদ্রের নীল রং, দ্বীপের ধূসর পাথর, পাহাড়ের সবুজ, জলের উপর নানা জাতীয় হাঁস, একটু নীচে প্রচুর মানুষের আনাগোনা আর চার পাশের সুন্দর সুন্দর নৌকো ও কয়েকটা বড় জাহাজ— সব মিলে মনে হচ্ছিল এই মুগ্ধতা পরিপূর্ণ হত তখনই, যদি অন্য প্রিয় জনরাও সঙ্গে থাকতেন। গনগনে রোদে এ বার ফেরার পালা। প্রায় মধ্য রাতে গোথেনবার্গে পৌঁছেও দেখি, সেখানে তখনও পুরোপুরি সূর্যের আলো।

উত্তরবঙ্গের একটি ছোট্ট গ্রামে কেটেছে ছোটবেলা। কর্মসূত্রে মালদহে বসবাস। পেশায় শিক্ষিকা। সম্প্রতি কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। বই পড়া, বেড়ানো, রান্না করার পাশপাশি সুযোগ পেলেই গিটার নিয়ে বসে পড়েন। মানুষের সঙ্গে মেলামেশাটাও একটা নেশা। আর ভাল লাগে লেখালেখি করতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE