শনিবার রাতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা বেস ক্যাম্প থেকে কাঠমান্ডু ফিরলাম। পাঁচ রাত হয়ে গেল, দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। খেতে পারছি না, চিন্তা করতে পারছি না কিছুই।
ছন্দা আমার নিজের বোনের মতো। এ বারের অভিযানে গিয়ে অনেক কাছ থেকে দেখেছি ওকে। সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি ছিল ওর মনের জোর। সেই জোরেই পা বাড়িয়েছিল ইয়ালুং কাং-এর পথে। ১৮ তারিখ, রবিবার কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল শৃঙ্গ জয়ের পরে নীচে নামলাম আমরা। পরের দিন, সোমবার রাতে ও যখন ফের কাঞ্চনজঙ্ঘা পশ্চিম শৃঙ্গে যাবে বলে জানাল, কোনও রকম বাধা দেওয়ার কথা ভাবিনি। জানতাম, যতই অসম্ভবের পথ হোক, ও পারবে। শেষ কয়েক দিনে ওকে যে ভাবে দেখেছিলাম, তাতে নিশ্চিত ছিলাম, ও পারবে।
সোমবার সকালে দীপঙ্কর আর টুসি নেমে গিয়েছিল সামিট ক্যাম্প থেকে। সারা দিনটা সামিট ক্যাম্পে একসঙ্গেই ছিলাম ছন্দা আর আমি। মাঝরাতে বেরিয়ে পড়ল ছন্দা। শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া অন্য কিছুর কথা মনেও হয়নি। কাঞ্চনজঙ্ঘা পশ্চিম ছিল ওর স্বপ্ন। ওর স্বপ্নের পথে বাধা দেওয়ার কথা ভাবতেও পারিনি। তবে একটাই কথা বলেছিলাম, “নিজের ক্ষমতার বাইরে বেরিয়ে কিছু করতে যাস না।”
শারীরিক ভাবে একদম সুস্থ ছিল ও। একটা শৃঙ্গ ছুঁয়ে আসার পরেও অন্য একটার লক্ষ্যে বেরোনোর আগে যে কতটা চনমনে থাকা যায়, তা আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাই বারবারই মনে হয়েছিল, ও পারবে।
মঙ্গলবার সকালে আমি বেসক্যাম্পের দিকে নামতে শুরু করি। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, খাড়া পাহাড়ের গা দিয়ে চার জনে মিলে এগোচ্ছে ওরা। ছন্দার সঙ্গে তাশি, দাওয়া ওয়াংচুক আর মিংমা পেমবা। আমি বেসক্যাম্পে পৌঁছই সন্ধের পরে। দীপঙ্করদা, টুসির সঙ্গে আর দেখা হয়নি সে দিন। পরের দিন মানে বুধবার ভোরে বেসক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যায় টুসি আর দীপঙ্করদা।
আমি অপেক্ষা করেছিলাম, পরের দিন ছন্দা ফিরলে, একসঙ্গে নামব আমরা। আমি আর ছন্দা নেপালের একই পর্বতারোহণ সংস্থার তরফে গিয়েছিলাম। দীপঙ্করদাদের (দীপঙ্কর ঘোষ) সংস্থা ছিল আলাদা। কিন্তু সকালে ভাবতেও পারিনি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবে তাশি। তা-ও ও রকম দুঃসংবাদ নিয়ে।
ঘটনাটা কী হয়েছিল, তা এখন সকলেরই জানা। তাশি ফেরার পরে কোনও রকমে জানিয়েছিল ঘটনাটা। আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় শৃঙ্গের একটু নীচ থেকে ফিরছিল ওরা। একটা দড়িতে তিন জন বাঁধা ছিল, দাওয়া, ছন্দা আর মিংমা পেমবা। ওদের ওপরে ছিল তাশি। তুষারধসটাকে নেমে আসতে দেখেছিল তাশিই। নিজে দড়িতে ছিল না বলে কোনও রকমে সরে গিয়েছিল তাশি। বলল, শেষ মুহূর্তে পা হড়কে যায় ছন্দার। বাকি দু’জনের চেষ্টায় আটকে যায় ও। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তত ক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। ওই জায়গাটা প্রায় ৮০ ডিগ্রি খাড়া। বরফের বিশাল চাঁইটার সঙ্গে অতলে মিলিয়ে যায় ছন্দারা।
বাকি সবার সঙ্গে আমার তফাত, দুর্ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে তার একটু কাছে ছিলাম আমি। তাশির মুখ থেকে খবরটা প্রথম শুনতে পাই আমি। এ ছাড়া আর নতুন কোনও তথ্য আমার কাছে নেই। প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার ওপরে কোনও কিছুর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
যখন কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল শৃঙ্গে উঠছিলাম, তখন আমাদের সঙ্গেও এমনটা হতে পারত।
খুব কঠিন ছিল সময়টা। আমার নিজের পায়ে একটা ছোট ফ্রস্ট বাইট হয়েছিল। কিন্তু সে সব নিয়ে কিছু ভাবার সময়ই পাইনি এখন পর্যন্ত। শুধু ছন্দাদের কথাই ভাবছিলাম। তল্লাশির কাজে হেলিকপ্টার আসবে, তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আবহাওয়া দেখে বুঝতেই পারছিলাম, নীচ থেকে হেলিকপ্টার পাঠানো অতটা সহজ হবে না। দু’দিন আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। তাশি তো আরও বিধ্বস্ত ছিল।
শুক্রবার দুপুরে হেলিকপ্টার নিয়ে এসে পৌঁছলেন উজ্জ্বলদারা। শনিবার ভোরে আকাশ সাফ ছিল। তাশিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ওঁরা। তবে বেশি ক্ষণ নয়, দুপুরের পরে আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাওয়ায় ফিরে আসে কপ্টার। খুব আশা করে ছিলাম, কোনও খবর যদি আসে। ছন্দার ওই উজ্জ্বল হলুদ রঙের পোশাকটার এক কণাও যদি চোখে পড়ে ওদের... বলাই বাহুল্য, কিছুই পাওয়া যায়নি।
শনিবার বিকেলে হেলিকপ্টারেই কাঠমান্ডু ফিরে এলাম উজ্জ্বলদাদের সঙ্গে। ওঁরা কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, উদ্ধারের কাজ যতটা সম্ভব দ্রুত করা যায়। আবহাওয়া বারবারই বাদ সাধছে। তবে এটাও ঠিক, মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে ছ’টা দিন। তবে একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। কালকে আবহাওয়া ভাল থাকলে আবারও যাবে কপ্টার।
অনুলিখন: তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy