উদ্দেশ্য ছিল পড়ুয়া ভর্তির ব্যবস্থায় গোলমাল এড়ানো, পাশাপাশি গোটা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার মোড়ক দেওয়া। দুই উদ্দেশ্যসাধনের লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করেছিল বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। সুফল মেলে হাতে-নাতে। বর্ধমানের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে এ বার রাজ্যের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও যখন একই পথে হাঁটার জন্য কোমর বেঁধেছে, তখন রাজ্য সরকারেরই একটি সিদ্ধান্ত এক ঝটকায় তাদের সকলকে ফিরিয়ে দিল পিছনের দিকে!
গত বছর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোয় কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইন পদ্ধতিতে ছাত্রভর্তি সফল হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, এ বছর থেকে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও স্নাতকস্তরে ছাত্রভর্তির একই প্রক্রিয়ায় সামিল হবে। সেই মতো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব পরিকাঠামো তৈরি করতে থাকে। ঠিক ছিল, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বেরোলেই ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।
কিন্তু পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের চব্বিশ ঘণ্টা আগে অনলাইন ভর্তি স্থগিত করে দিয়েছে মমতা সরকারেরই উচ্চশিক্ষা দফতর। রাজ্যের নতুন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় রাতারাতি মত বদলে বৃহস্পতিবার জানিয়ে দিয়েছেন, অনলাইন ভর্তি প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করার যথেষ্ট প্রস্তুতি সর্বত্র নেই। পরিকাঠামো ও প্রযুক্তিগত খামতি রয়েছে। তাই ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকস্তরে ছাত্রভর্তিতে কেন্দ্রীয় অনলাইন পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা যাচ্ছে না। “যে সব কলেজ পারবে, তারা করবে।”— বলেন শিক্ষামন্ত্রী।
শেষ মুহূর্তে এসে পরিকাঠামো ও প্রযুক্তিগত কী খামতি ধরা পড়ল? নতুন শিক্ষামন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের তরফে তার কোনও স্পষ্ট ও বোধগম্য ব্যাখ্যা মেলেনি। শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কলেজ-ভিত্তিক ফর্ম
বিলি ও জমা নেওয়ার মাধ্যমে ভর্তির সেই সাবেক প্রক্রিয়া চালু করতে হবে ১০ জুনের মধ্যে। যা শুনে কার্যত অথৈ জলে পড়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিকেরা। পরিকাঠামো-প্রযুক্তিতে
‘খামতি’ থাকার যে যুক্তি শিক্ষা দফতর দিয়েছে, ওঁদের একাংশ তার সঙ্গেও পুরোপুরি সহমত হতে পারছেন না। বরং ওঁরা বলছেন, মঙ্গলবার শিক্ষা দফতরের সর্বশেষ রিভিউ বৈঠকে বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু যখন অনলাইন ভর্তির প্রস্তুতি সম্পর্কে মতামত চান, তখন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছিল, তারা তৈরি। “বাকিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সময়সীমার আগেই চূড়ান্ত প্রস্তুতি সেরে ফেলবে।”— শুক্রবার দাবি করেন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা।
এমতাবস্থায় সরকারি সিদ্ধান্ত শুনে বিস্ময় লুকোতে পারছেন না উচ্চশিক্ষার সঙ্গে জড়িত অনেকেই। ওঁদের মতে, ভর্তির প্রক্রিয়া সরল করার স্বার্থে তো বটেই, ভর্তির ময়দানে ছাত্র সংসদ নেতাদের ‘দাদাগিরি’ ঠেকানোর জন্যও অনলাইন পদ্ধতি হতো উপযুক্ত দাওয়াই। “কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকার এক পা এগিয়েও দু’পা পিছিয়ে এল!”— আক্ষেপ এক শিক্ষাবিদের। উপরন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের দাবি: অনলাইন পদ্ধতিতে জটিলতা যেমন কম, তেমন নিরাপত্তা বেশি। প্রযুক্তিগত বিভ্রাট ঘটলে তড়িঘড়ি সারিয়ে ফেলাও সম্ভব।
বস্তুত রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও তথ্যপ্রযুক্তির একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, অনলাইন ভর্তিতে যে পরিকাঠামো বা সফ্টওয়্যার লাগে, তা এমন কিছু উঁচু দরের প্রযুক্তি নয়। বরং সেটা বানানো নিতান্ত সহজ। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, লোকসভা নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় তখন তাঁরা অনলাইন ভর্তি-প্রস্তুতির বরাত দেওয়ার জন্য টেন্ডার ডাকতে পারেননি। সরকারি সংস্থা ওয়েবেল-কে প্রকল্প রূপায়ণের ভার দেওয়া হয়েছিল। ওয়েবেল আবার কাজে লাগায় এক বেসরকারি সংস্থাকে, যারা খুব অল্প সময়ে নির্ভুল ভাবে
কাজ তুলে দেয়।
প্রসঙ্গত, ওই পেশাদার সফ্টওয়্যার সংস্থাটিই গত বছর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ভর্তি ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিল। সেই পদ্ধতিতে যে ভাল কাজ হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তাদের পাশাপাশি শিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরাও তা মেনে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়-সূত্রের খবর, বর্ধমানে গত বছর অনার্স পাঠ্যক্রমে অনলাইনে ছাত্রভর্তি হয়েছিল। যে কারণে অধীনস্থ ৯১টি কলেজের মধ্যে ৮৯টিকে এর আওতায় আনা হয়, কারণ বাকি দু’টোয় অনার্স কোর্স নেই। অনলাইন পদ্ধতির দৌলতে তিরিশটি অনার্স বিষয়ের প্রায় চল্লিশ হাজার আসনে খুব সহজেই ভর্তি প্রক্রিয়া সেরে ফেলা গিয়েছিল বলে দাবি করেছেন বর্ধমানের কর্তারা।
আরও একটা সুবিধে টের পেয়েছেন ওঁরা। অনলাইনের সুবাদে অহেতুক আসন আটকে রাখার প্রবণতাও কমছে! কী রকম?
এক কর্তা বলেন, “আগে ফি বছর সেশনের গোড়ার দিকে দেখা যেত, অনার্সের সব সিট প্রায় ভর্তি। অথচ ক্লাস শুরুর ক’দিন বাদে একে একে বিস্তর সিট খালি হয়ে যাচ্ছে! সেখানে পাসের ছেলেমেয়েরা ঢুকছে।” এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি— “আলাদা আলাদা কলেজে আলাদা আলাদা ভর্তি পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে এক-এক জন পড়ুয়া তিন-চারটে আসনও আটকে রাখতে পারত। শেষমেশ একটা কলেজে ভর্তি হয়ে বাকিগুলো ছেড়ে দিত।” কিন্তু গত বছর অনলাইনে কেন্দ্রীয় ভাবে ভর্তির পদ্ধতি কাউকে একাধিক আসন আটকাতে দেয়নি। তাই ভর্তি প্রক্রিয়া সাঙ্গ হলে দেখা গিয়েছে, অনার্সে প্রায় ১৫ হাজার আসন খালি!
আসন আটকানোর প্রবণতা কলকাতা, বিদ্যাসাগর বা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজেও বড় সমস্যা। সেখানকার কর্তারা আশায় ছিলেন, এ বার কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইন ভর্তি চালু হলে ছবিটা হয়তো বদলাবে। সরকারের সিদ্ধান্ত এ ক্ষেত্রেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে অনলাইন ভর্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে কলেজ-শিক্ষকদের একাংশের মনে প্রশ্নও রয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, অনলাইনে শহরের পড়ুয়ারা সুবিধা পেত বটে, কিন্তু অসুবিধেয় পড়ত প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জের পড়ুয়ারা। অনলাইনে ভর্তির আবেদন করাটা তাদের সকলের পক্ষে সহজ হতো না বলে শিক্ষকদের এই মহলের দাবি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্তা-ব্যক্তিদের সিংহভাগ এমন আশঙ্কার ভিত্তি দেখছেন না। কোন যুক্তিতে?
ওঁরা জানাচ্ছেন, আবেদনের জন্য ওয়েবসাইটে বাংলা-ইংরেজিতে নির্দেশাবলি থাকত। কথা ছিল, অনলাইন ভর্তিতে সাহায্য করতে গ্রামে-গ্রামে বিডিও অফিসে হেল্পডেস্ক খোলা হবে। থাকবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হেল্পলাইন ও কন্ট্রোল রুম। “গ্রামে বা ব্লকে ইদানীং অনেক সাইবার কাফে চলে। সেখানেও সাহায্য মিলত।”— মন্তব্য এক বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তার।
সব মিলিয়ে প্রযুক্তির সুবিধে হাতছাড়া হওয়ার জন্য দীর্ঘশ্বাসই প্রকট উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy