Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ছন্দার খোঁজ নেই, বাড়িতে নেতার ভিড়

কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের আগে স্পনসর পেতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল ছন্দা গায়েনের। প্রথমে এগিয়ে আসেননি কেউই। সেই ছন্দারই বাড়িতে এখন নেতা-মন্ত্রীদের যাতায়াতের বিরাম নেই। বিরাম নেই সহায়তার প্রতিশ্রুতিরও। যদিও দুর্ঘটনার দু’দিন পরেও শুরু হয়নি উদ্ধারকাজ।

হাওড়ার বাড়িতে ছন্দার মা জয়া গায়েন। বৃহস্পতিবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

হাওড়ার বাড়িতে ছন্দার মা জয়া গায়েন। বৃহস্পতিবার। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৪ ০২:২৫
Share: Save:

কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানের আগে স্পনসর পেতে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল ছন্দা গায়েনের। প্রথমে এগিয়ে আসেননি কেউই। সেই ছন্দারই বাড়িতে এখন নেতা-মন্ত্রীদের যাতায়াতের বিরাম নেই। বিরাম নেই সহায়তার প্রতিশ্রুতিরও। যদিও দুর্ঘটনার দু’দিন পরেও শুরু হয়নি উদ্ধারকাজ।

এই অবস্থায় কারও কোনও আশ্বাসই আর ভরসা জোগাতে পারছে না ছন্দার পরিবারকে। দুর্ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরে মেয়ে কেমন আছে, জনে জনে প্রশ্ন করে চলেছেন ছন্দার মা জয়া গায়েন। জবাব মিলছে না। বুধবার পর্যন্তও মন শক্ত করে কথা বলছিলেন। বৃহস্পতিবার যত সময় গড়িয়েছে, ততই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। সন্ধ্যায় জয়াদেবী বললেন, “রাজ্য বা কেন্দ্র— কেউই মেয়ের খবর দিচ্ছে না। এটাই সব থেকে বড় আফসোস।’’

কাঞ্চনজঙ্ঘার পশ্চিম শৃঙ্গ জয় করতে গিয়ে মঙ্গলবার তুষারধসের কবলে পড়েন এভারেস্টজয়ী বাঙালি মেয়ে ছন্দা এবং দুই শেরপা— মিংমা পেমবা শেরপা ও দাওয়া ওয়াংচুক। তার পর থেকে আর খোঁজ নেই তাঁদের। বুধবার খবর পেয়েই ছন্দার হাওড়া-কোনা বাগপাড়ার বাড়িতে যান রাজ্যের যুব কল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং হাওড়ার তৃণমূল নেতা অরূপ রায়। মন্ত্রী অরূপবাবুর ফোন মারফত ছন্দার মা জয়াদেবীর সঙ্গে কথা বলে তাঁকে আশ্বস্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ছন্দার বাড়িতে আনাগোনা শুরু হয়ে যায় বিরোধী দলের নেতাদেরও। এ-সব দেখেশুনে ছন্দাদের প্রতিবেশী সঞ্জয় রায় বলেন, “আমরা রাজনীতি চাই না। মেয়েকে ফেরত চাই।”

এ দিন সকালে ছন্দার বাড়িতে যান সিপিএম নেতা শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। তিনি ছন্দার পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। বিকেল সওয়া ৪টে নাগাদ যান বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। কেন্দ্র উদ্ধারকাজে সেনা নামাচ্ছে না কেন, সেই প্রশ্নের মুখে পড়ে তিনি বলেন, “কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সেনা নামানোর কথা ভাবা হচ্ছে।”

বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ ছন্দার বাড়িতে হাজির হন দুই কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য ও অসিত মিত্র। বাগপাড়ায় দাঁড়িয়েই রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ফোন করে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন প্রদীপবাবু। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা উদ্ধারকাজ জোরদার করার আর্জি জানিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখছি।”

প্রদীপবাবু বেরিয়ে যাওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই ছন্দার বাড়িতে পৌঁছন সেচমন্ত্রী রাজীববাবু, হাওড়ার সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় ও মেয়র রথীন চক্রবর্তী। রাজীববাবু আশ্বাস দেন, “উদ্ধারকাজ চলছে। শুক্রবার থেকে তা জোরদার হবে।” আজ, শুক্রবার ভারত ও নেপাল সেনা যৌথ ভাবে উদ্ধারকাজ করবে বলে তিনি জানান।

যদিও উদ্ধারকাজ কতটা চলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রয়েছে বিভ্রান্তিও। সন্ধ্যা পৌনে ৭টা নাগাদ ছন্দার বাড়িতে পৌঁছে নেপালের কনসাল জেনারেল চন্দ্রকুমার গিমেরি ও ডেপুটি কনসাল সুরেন্দ্র থাপা জানান, সকাল ছাড়া উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব নয়। প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারও কাজ করতে পারছে না। গিমেরি বলেন, “ভারতীয় সেনার কাছ থেকে কোনও খবর পাইনি। নেপাল চেষ্টা করছে।”

বুধবার রাজ্য যুবকল্যাণ দফতরের পক্ষ থেকে দুই এভারেস্টজয়ী উজ্জ্বল রায় ও দেবদাস নন্দী-সহ তিন জনের একটি দলকে নেপাল পাঠানোর কথা জানানো হয়েছিল। এ দিন তাঁরা কাঠমান্ডু রওনা দেন। তাঁরা শুক্রবার কাঠমান্ডু পৌঁছে স্থানীয় পর্বতারোহণ সংস্থাগুলির সঙ্গে কথা বলে উদ্ধারকাজ শুরু করার ব্যবস্থা করবেন।

এ ভাবে সময় নষ্ট হওয়ায় উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে বলে মনে করেন রাজ্যের অভিযাত্রীদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, শুক্রবার উদ্ধারকাজ শুরু হলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছতে আরও দিন তিনেক লাগবে। তা ছাড়া আবহাওয়া প্রতিকূল থাকলে শেরপাদের পৌঁছনোও প্রায় অসম্ভব।

সময়টা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন আট বারের এভারেস্টজয়ী পাসাং শেরপাও। তিনি বলেন, “দুর্ঘটনার পরে অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। ওদের ফিরে পাওয়াটা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে।” কেন কঠিন হয়ে পড়ছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান, বেসক্যাম্প থেকে দুর্ঘটনাস্থল অন্তত তিন দিনের পথ। খাবার-পানীয়ের রসদ নিয়ে সেখানে গিয়ে খোঁজখবর শুরু করা কার্যত অসম্ভব। একই সুর মিংমা শেরপার গলায়। ছন্দার অভিযানের ব্যবস্থাপক আরোহণ সংস্থার কর্ণধার মিংমা ফোনে বললেন, “কপ্টার তৈরি আছে। আবহাওয়া একটু সাফ হলেই...।”

পর্বতারোহণে অভিজ্ঞতা রয়েছে হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসুর। তিনি বলেন, এই ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে একটা ঘণ্টাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। শুধু সময়ের কারণে শেষ হয়ে যায় সব ‘মিরাক্ল’-এর সম্ভাবনা। তাঁর কথায়, “খবর পাওয়া মাত্রই শিলিগুড়ি থেকে কয়েক জন আরোহী কাঠমান্ডু চলে গেলে কাজটা অনেক এগিয়ে থাকত।” দুর্ঘটনার পরে রাজ্যের যুব কল্যাণ দফতর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। অনিমেষবাবু ন্যাফের কয়েক জন অভিযাত্রী-সদস্যকে শিলিগুড়ি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্পে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। “সে-ক্ষেত্রে অন্তত ৪৮ ঘণ্টা এগিয়ে থাকতে পারতাম আমরা,” মন্তব্য অনিমেষবাবুর। তাঁর মতে, কেউ না-পৌঁছনো পর্যন্ত শুধু নেপালের আরোহণ সংস্থার উপরে নির্ভর করে থাকতে হয়। আর তাদের হেলিকপ্টার পাঠানো বা শেরপা পাঠানো এ-সবের পিছনেই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে। নিজেদের লোক ঘটনাস্থলে থাকলে পুরোটাই অনেক সুষ্ঠু ভাবে হয়।

একই মত কারাকোরাম থেকে অরুণাচল পর্যন্ত ‘ট্রান্স-হিমালয়’ অভিযাত্রী রাজীব মণ্ডলের। তিনি জানান, ১৯৯৮ সালে শিবলিঙ্গ অভিযানে গিয়ে পাশেই কেদারডোম অভিযানের তিন আরোহীকে উদ্ধার করেছিলেন তাঁরা। “আমরা পাশেই ছিলাম বলে উদ্ধারকাজ অতটা সহজ হয়েছিল,” বললেন রাজীববাবু।

গত বছর কারাকোরামের সাত-হাজারি শৃঙ্গ প্ল্যাটো জয় করে শিরোনামে এসেছিলেন দেবরাজ দত্ত। ২০০১ সালে নন্দকোট অভিযানে গিয়ে তিন জন অভিযাত্রীকে উদ্ধার করেছিলেন তাঁরা। দেবরাজবাবুর মতে, যুব কল্যাণ দফতর পাকাপাকি ভাবে একটা উদ্ধারকারী দল তৈরি করতে পারে। “দুর্ঘটনার খবর মিলতেই তাঁরা বেরিয়ে পড়তে পারবেন। নষ্ট হবে না অমূল্য সময়,” বললেন দেবরাজবাবু।

উদ্ধারকাজ কী ভাবে হতে পারে, তা নিয়ে নানা মতের মধ্যেই মেয়ের পথ চেয়ে বসে আছেন জয়াদেবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

chanda gayen missing on Kanchenjunga
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE