Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ঝাঁঝও নেই, বার্তাও নেই

ছোট বক্তৃতায় উদ্বেগ দলের লবিবাজি নিয়ে

লোকসভা ভোটে বিপুল জয়ের পরে কলকাতার বুকে প্রথম বড় সমাবেশ। অথচ সেই মঞ্চ থেকেই স্মরণকালের মধ্যে সংক্ষিপ্ততম বক্তৃতাটি দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু সময়সীমার নিরিখে নয়, ধারে এবং ভারেও বেশ নিষ্প্রভ রইল তৃণমূল নেত্রীর এ বারের একুশে জুলাইয়ের বক্তৃতা। বিরোধীদের চড়া সুরে আক্রমণ নেই। শিল্পায়ন নিয়ে কার্যত কোনও কথা নেই। দিশা নির্দেশ, কর্মসূচি নেই দলীয় কর্মীদের জন্যও।

সোমবার ধর্মতলায়।  নিজস্ব চিত্র

সোমবার ধর্মতলায়। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৪ ০৩:৪১
Share: Save:

লোকসভা ভোটে বিপুল জয়ের পরে কলকাতার বুকে প্রথম বড় সমাবেশ। অথচ সেই মঞ্চ থেকেই স্মরণকালের মধ্যে সংক্ষিপ্ততম বক্তৃতাটি দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু সময়সীমার নিরিখে নয়, ধারে এবং ভারেও বেশ নিষ্প্রভ রইল তৃণমূল নেত্রীর এ বারের একুশে জুলাইয়ের বক্তৃতা।

বিরোধীদের চড়া সুরে আক্রমণ নেই। শিল্পায়ন নিয়ে কার্যত কোনও কথা নেই। দিশা নির্দেশ, কর্মসূচি নেই দলীয় কর্মীদের জন্যও। থাকার মধ্যে দলে শুদ্ধকরণের ডাক। আধ ঘণ্টার বক্তৃতার বেশির ভাগ সময়ই খরচ হল সেই কাজে।

ঘটনা হল দলের নাম করে টাকা তোলা যাবে না, কেউ অন্যায় করবেন না, অন্যায় বরদাস্ত করা হবে না এমন কথা এর আগেও বহু বার বলেছেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যে হেতু তৃণমূল কর্মীদের বিচ্যুতিকে বারবার ‘ছোট ঘটনা’ বলে লঘু করেছেন তিনি নিজেই, সে হেতু এই সতর্কবার্তাতে কাজের কাজ কতটা হবে, সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

এ দিনও চতুর্দিক থেকে তাঁর দলের লোকজনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমের কুৎসা বলে উড়িয়ে মমতা বলেছেন, “অনেকে ভাবছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কুৎসা করি, বদনাম করি! আরও অপপ্রচার করি! কিন্তু তারা জানে না, তৃণমূল আর রাজনৈতিক দল নয় রে! এটা মানুষের দল। তৃণমূলের নামে কুৎসা হলে মানুষের গায়ে লাগে!”

কিন্তু একই সঙ্গে মমতা এ দিন যে ভাবে বারবার তৃণমূল কর্মীদের টাকা তোলা-সহ নানা অন্যায় থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন, তাতে তাঁর উদ্বেগ স্পষ্ট। স্পষ্ট যে, সব ঘটনাই ‘সাজানো’ বলে উড়িয়ে দিতে পারছেন না তিনি নিজেও। তাই তাঁকে বারবার কর্মীদের উদ্দেশে বলতে হয়েছে, “আমাদের মাটির সঙ্গে থাকতে হবে। মাটির গভীরে যেতে হবে। মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।” তৃণমূল কর্মীদের প্রতি তাঁর এই পরামর্শও অবশ্য নতুন নয়।

মমতার আর পাঁচটি জনসভার চেয়ে এ দিন বক্তৃতার সুর আলাদা শুনিয়েছে একটি জায়গাতেই। যখন দলের নেতৃস্থানীয়দের জন্য প্রায় হুঁশিয়ারি জারি করে তিনি বলেছেন, “তৃণমূল এমন একটা দল, যেখানে টিকিট বিক্রি হয় না। টাকা দিয়ে নেতা হওয়াও যায় না। মানুষের পাশে থেকে নীরবে কাজ করুন। আমি খুঁজে নেব! লবি করার দরকার নেই!” মমতা বলেছেন, নেতা হব নেতা হব বলে চিৎকার করলেই নেতা হওয়া যায় না! তাঁর কথায়, “স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, নেতা কখনও গাছ থেকে পড়ে না। কাজের মধ্যে দিয়ে উঠে আসে।”

তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, হালফিল পরিস্থিতির চাপই শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে দলনেত্রীকে এমন সতর্কতা জারি করতে বাধ্য করেছে। এ দিনই জামুড়িয়ায় তোলা আদায় এবং অফিসারদের হুমকি দেওয়ার ঘটনায় স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের নামে শ্যাম শিল্প-গোষ্ঠীর অভিযোগ গ্রহণ করেছে পুলিশ। ক’দিন আগেই প্রকাশ্যে চূড়ান্ত অশালীন কথা বলেছেন সাংসদ তাপস পাল। রাজ্য জুড়েই তৃণমূলের বিরুদ্ধে নানা স্তরে নানা নালিশ আসছে। সেই আবহেই এ দিন মমতাকে বলতে হয়েছে, “৩৪ বছর আন্দোলন করে কাটিয়েছি। লড়াই করে দলটা তৈরি হয়েছে। অন্যায় আমরা করব না। অন্যায় করতে আমরা দেব না।”

কাদের উদ্দেশ করে এ সব বললেন মমতা?

তৃণমূলের একাংশ মনে করছে, দিনকয়েক আগে দলীয় সভায় মুকুল-পুত্র তথা দলের যুব নেতা শুভ্রাংশু রায়ের মন্তব্যেই মমতার এ দিনের হুঁশিয়ারির বীজ নিহিত! টেন্ডার-রাজ, গরু পাচার থেকে শুরু করে সাট্টা-জুয়া-চোলাইয়ের কারবারে দলের একাংশের জড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে খানিকটা আচমকাই সরব হয়েছিলেন মিতবাক বলে পরিচিত শুভ্রাংশু। তাঁর সেই বক্তব্যকে প্রকৃতপক্ষে তৃণমূল নেত্রীর প্রতি মুকুল রায়-লবির বার্তা হিসেবে দেখছিল শাসক দলের একাংশ। এ দিন তৃণমূল নেত্রী নিজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখও খুলেছেন, আবার একই সঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলের মধ্যে লবিবাজি তাঁর না-পসন্দ। যাঁরা নেতা হওয়ার জন্য লবি করছেন, তাঁদের কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়ার পাশাপাশি উপরের দিকে যে সব নেতা লবিবাজি প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাঁদেরও সতর্ক করেছেন তিনি।

ঘনিষ্ঠ মহলে অবশ্য তৃণমূল নেত্রীর দাবি, তাঁর দলে লবি বা গোষ্ঠীর লড়াই আদপেই প্রবল নয়। যে কোনও পেশাতেই সমকক্ষদের মধ্যে মানসিক রেষারেষি থাকে। তেমনই তৃণমূলেও মুকুল-সুব্রত বক্সী বা সমগোত্রীয় নেতাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব থাকতে পারে। কিন্তু সেই ধরনের বিবাদ রাস্তায় নেমে আসছে, এমন ঘটনা নিতান্তই হাতে-গোনা। সামান্য কিছু দৃষ্টান্তকে সংবাদমাধ্যম সারা রাজ্যের ঘটনা বলে প্রচার করছে। মমতার ব্যাখ্যা, তিনি তাঁর দলের পরবর্তী প্রজন্মের নেতা-কর্মীদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, লড়াই-আন্দোলন করেই তৃণমূল তৈরি হয়েছে। তোলাবাজি বা লবি করে নয়! বস্তুত মঞ্চেও এ দিন মমতা বলেছেন, “একটা প্রজন্ম ৩৪ বছর লড়াই করেছে। আর একটা প্রজন্ম চাই, যারা ৪০ বছর কাজ চালাতে পারবে।” দলনেত্রীর এমন বার্তার সময়ে ওই মঞ্চেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভ্রাংশু বা সৌমিত্র খাঁ-র মতো তৃণমূলের যুব নেতারা। যাঁদের মধ্যে সম্পর্কের নানা টানাপড়েন দলের অন্দরে-বাইরে অনেকেরই অজানা নয়।

এ দিন বারবারই স্বচ্ছতার আদর্শের কথা ঘুরেফিরে এসেছে মমতার কথায়। রাজ্য সরকার কত কাজ করছে, তার ফিরিস্তি ছিল সংক্ষিপ্ত, বিজেপির প্রতি আক্রমণও তা-ই। জানুয়ারিতে ব্রিগেড হবে বলা ছাড়া, তেমন কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিও ছিল না। বরং মমতা অনেক বেশি সময় নিয়ে বলেছেন, কী করে ভাল কর্মী হতে হয়। ঘোষণা করেছেন, “আমার দল চালাতে কাউকে টাকা দেওয়ার দরকার নেই। ভোট এলে আবার ছবি আঁকব, কবিতা লিখব। কেউ কেউ ছবি বিক্রি করা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। দল চালাতে ছবি বিক্রি করবে না তো কী করবে?”

যা শুনে বিরোধীদের কেউ কেউ পরে কটাক্ষ করে বলেছেন, নেত্রীর ছবির পরবর্তী ক্রেতার কি খোঁজ পাওয়া গিয়েছে?

বিরোধীদের আরও বক্তব্য, এই ধরনের মঞ্চ থেকে মমতা বরাবরই ভাল ভাল কথা বলেন। কিন্তু ঘটনা ঘটলে অভিযুক্তদের নিজেই আড়াল করেন! বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর প্রশ্ন, “উনি বলেছেন, অপরাধ করলে শাস্তি দেন। অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলাম, তাপস পালের কী শাস্তি হয়েছে, বাংলার মানুষ জানেন না! উনি জানাবেন?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও বক্তব্য, “ওঁর দলের ছেলেরা কাজ কী করছে, দেখাই তো যাচ্ছে! শুধু আদর্শের কথা শুনে লাভ কী?” মানস ভুঁইয়ার খেদ, “কোথায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জেহাদ? কোথায় সুদ মকুবের দাবি? মুখ্যমন্ত্রীর সেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিই তো উধাও!”

২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে প্রথম একুশে জুলাইয়ের সমাবেশে দলীয় কর্মীদের জন্য দশ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন মমতা। পরের বছরের বক্তৃতায় ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে একাই পঞ্চায়েত ভোটে লড়ার ইঙ্গিত। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ২১ জুলাই পালন করা হয়নি। তার বদলে সমাবেশ হয়েছিল এ বছরের ৩০ জানুয়ারি। সেখানেও লোকসভা ভোট সামনে রেখে কংগ্রেস ও বিজেপির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিলেন তিনি। এ বারের সমাবেশে মমতা যেন কার্যত দিশাহীন!

ফলে ‘দিদি’র বক্তৃতায় স্বাভাবিক ভাবেই মন ভরেনি তৃণমূলের অনেকেরই। মমতাকেও বারবারই কর্মীদের কিছুটা মিইয়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে অনুযোগ করতে হয়েছে। তৃণমূল নেত্রী যদিও পরে ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, অল্প কথায় যদি প্রয়োজনীয় বার্তা দিয়ে দেওয়া যায়, তাতে ক্ষতি কী? বিজেপি-র মোকাবিলায় রাজনৈতিক বার্তা এবং দল সামলানোর জন্য শৃঙ্খলার বার্তা, সবই তিনি দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mamata bandyopadhyay tmc tmc rally 21 july
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE