প্রকাশ্যে ধূমপান ও গুটখা খাওয়া বন্ধে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক পুলিশকে জরিমানা করতে কড়া নির্দেশ দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরেও কলকাতা রয়ে গেল কলকাতাতেই। শহরের যত্রতত্র চলল প্রকাশ্যে ধূমপান, তামাকজাত দ্রব্যের বেচাকেনা। স্কুল-কলেজের সামনেও পানমশলা-সিগারেট বিক্রি হল রমরমিয়ে। তাতে নজরদারি দূরে থাক, খোদ উর্দিধারী পুলিশের সুখটান এবং তাঁদের নাকের ডগাতেই পানমশলা-জর্দার প্যাকেট বিক্রির ছবি ধরা পড়ল চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরায়। এমনকী প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে প্রায় তেড়ে এলেন তরুণ-তরুণী।
অনেকের মতে, বিষয়টিতে বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে সরকারি নির্দেশনামায় ‘পাবলিক প্লেস’-এর সংজ্ঞা। সেখানে এক দিকে যেমন স্কুল-কলেজ, সিনেমা-থিয়েটার, অফিস-আদালত, যানবাহন ইত্যাদিতে ধূমপান বা গুটখা খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তেমনই বলা হয়েছে, কোনও খোলা জায়গা এই নিষেধের আওতায় আসবে না। সেখানেই অনেকের ব্যাখ্যা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে, চলতে চলতে বা খোলা মাঠে-ময়দানে ধূমপান করলে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। অনেকে আবার এই ব্যাখ্যার বিরোধী। তাঁদের মতে, যেখানে জনসমাগম হয় বা জনগণের যাতায়াত আছে, সেটাই ‘পাবলিক প্লেস’।
আইনি ব্যাখ্যার এই ফাঁক গলেই হয়তো নির্বিবাদে সিগারেট এবং ঘুরপথে গুটখার প্রকাশ্য ব্যবহার জারি রেখেছে কলকাতা।
বৃহস্পতিবার দুপুর। আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিগারেটের দোকানে সারি সারি ঝুলছে জর্দা-পানমশলার প্যাকেট। বিক্রি হচ্ছে সিগারেটও। প্রাপ্তবয়স্করা তো বটেই, কিশোর ধূমপায়ীরাও কিনে প্রকাশ্যেই খাচ্ছে সে সব। ওই রাস্তায় একটি কলেজের সামনে ফুটপাথের রেলিংয়ে বসে সিগারেটে টান দিচ্ছিলেন তরুণ। সরকারি নির্দেশের কথা তুলতেই তাঁর উত্তর, “নিষেধ তো অনেক কিছুতেই। কিন্তু শুনছে কে?”
বিকেলের পার্ক স্ট্রিট মোড়। গুটখা-পানমশলার প্যাকেট কিনে প্রকাশ্যেই মুখে ঢাললেন এক যুবক ও তাঁর সঙ্গিনী। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যে? প্রশ্ন শুনে প্রায় তেড়ে এলেন দু’জনে। যুবকের উত্তর, “নিজের পয়সায় কিনে খাচ্ছি। ও সব নির্দেশের পরোয়া করি না। জরিমানারও না।” আর সঙ্গিনী বলছেন, “কই পুলিশও তো কিছু বলছে না!”
সন্ধ্যার টালিগঞ্জ। মেট্রো স্টেশন লাগোয়া ফুটপাথে প্রকাশ্যেই বিকোল জর্দা-পানমশলা। সে সব কিনে, মিশিয়ে গুটখা বানিয়ে ক্রেতারা খেলেনও প্রকাশ্যেই। এক দোকানদারকে প্রশ্ন করতেই জবাব এল, “কই, পুলিশ তো আমাদের বিক্রি করতে নিষেধ করেনি।”
অথচ দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী রাজ্যের স্বাস্থ্য এবং খাদ্য দফতরের অফিসার ছাড়াও পুলিশের সাব-ইনস্পেকক্টর বা তার চেয়ে বেশি পদমর্যাদার অফিসারেরা আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ দিন শহরের এখানে-ওখানে সেই পুলিশকর্মীদেরও অবশ্য দেখা গিয়েছে সিগারেটে সুখটান দিতে। রাজপথে ট্রাফিক সিগন্যালে তাঁদের চোখের সামনে দিব্যি জর্দা-পানমশলার প্যাকেট বিক্রি করেছেন হকার।
প্রকাশ্যে সিগারেট ও গুটখা বন্ধে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ার পরে শহরের নানা ছবি। বৃহস্পতিবার।—নিজস্ব চিত্র।
পাবলিক প্লেসে সিগারেট-গুটখা খেলে জরিমানা করার আইন চালু ২০০৩ সাল থেকে। এত দিন এই জরিমানা আদায়ের দায়িত্ব ছিল মূলত স্বাস্থ্য দফতরের। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে ওই নির্দেশ কার্যত রয়ে গিয়েছিল খাতায় কলমেই। সম্প্রতি এক নির্দেশিকায় পুলিশকেও অবিলম্বে এই আইন কড়া হাতে কার্যকর করতে আদেশ দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। বুধবার সেই নির্দেশ জারির ২৪ ঘণ্টা পরেও যে ক্রেতা-বিক্রেতা কিংবা প্রশাসন কারওরই কোনও হেলদোল নেই, বৃহস্পতিবার দিনভরের কলকাতার ছবিটা থেকেই তা স্পষ্ট।
কিন্তু পুলিশ কেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশ কার্যকর করতে উদ্যোগী হচ্ছে না? লালবাজারের এক কর্তা জানান, এখনও এ নিয়ে উপরমহল থেকে নির্দেশ আসেনি।
তবে রাস্তায় তামাক-সেবনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। আইনে বলা হয়েছে, যে কোনও ‘পাবলিক প্লেসে’ তামাক সেবন নিষিদ্ধ। ‘পাবলিক প্লেস’ কাকে বলা হবে? সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে তার যে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, তাতে আছে: অডিটোরিয়াম, হাসপাতাল, রেলের ওয়েটিং রুম, বিনোদনকেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, সরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি, গণ-পরিবহণ ইত্যাদির নাম। কিন্তু রাস্তা সম্পর্কে এখানে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। তাই রাস্তায় তামাক সেবন বেআইনি নয় বলে অনেকেরই দাবি।
এ নিয়ে কী বলছেন আইনজীবীরা? আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যেখানে জনসাধারণের যাতায়াত আছে, আইন অনুযায়ী, সেটাই পাবলিক প্লেস। রাস্তা, ফুটপাথ এর বাইরে নয়। তাই রাস্তা বা ফুটপাথে তামাক সেবন বেআইনি।” প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার মনে করেন, “সরকারি সংজ্ঞায় পাবলিক প্লেসের যে উদাহরণ রয়েছে, তাতে রাস্তা বা ময়দানের মতো খোলা জায়গায় ধূমপান আটকানো কঠিন। কারণ সেখানে স্পষ্ট বলা রয়েছে, কোনও খোলা জায়গা পাবলিক প্লেসের আওতায় পড়বে না। এটি এই নির্দেশনামার অস্বচ্ছতা।”
তামাক বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ক্যানসার-চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “এ আইনের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি আটকানো। রাস্তায় ধূমপানে অন্যের ক্ষতি হয়। সেখানেও ধূমপান বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy