Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

পুলিশের যত সক্রিয়তা বিরোধীদের বেলাতেই

একই রাজ্য। একই পুলিশ। একই আইন। শুধু ব্যক্তিবিশেষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার প্রয়োগ ভিন্ন। কোথাও দুর্বল অভিযোগে পুলিশ অতিসক্রিয় হয়ে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে হেনস্থা করছে বলে অভিযোগ। কোথাও খুনখারাপি, বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর কিংবা ভোটারদের উপরে আক্রমণের মতো গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা দূরে থাকুক, জিজ্ঞাসাবাদই করা হচ্ছে না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৪ ০৩:২৩
Share: Save:

একই রাজ্য। একই পুলিশ। একই আইন। শুধু ব্যক্তিবিশেষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার প্রয়োগ ভিন্ন।

কোথাও দুর্বল অভিযোগে পুলিশ অতিসক্রিয় হয়ে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে হেনস্থা করছে বলে অভিযোগ। কোথাও খুনখারাপি, বুথে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর কিংবা ভোটারদের উপরে আক্রমণের মতো গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা দূরে থাকুক, জিজ্ঞাসাবাদই করা হচ্ছে না।

রাজ্যের নামী আইনজীবী থেকে পুলিশ অফিসারদেরই একাংশ এই প্রবণতাকে মেরুকরণের সমস্যা বলে মনে করছেন। তাঁদের মতে, এর ফলে শুধু যে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় তাই নয়, প্রশাসনের উপরে সাধারণ মানুষের আস্থাও চলে যায়।

সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয় থেকে শুরু করে নাট্যকার সুমন মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি পুলিশের এই অতিসক্রিয়তার শিকার। আবার হাবড়ার বিধায়কের বিরুদ্ধে নির্বাচনের আগে হাবড়ার বিডিও-র উপরে হামলার অভিযোগ উঠেছিল। বিডিও থানায় অভিযোগও দায়ের করেছিলেন। কিন্তু সেই বিধায়ককে পুলিশ নামমাত্র জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দিয়েছে। উল্টে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র বিডিও দীনবন্ধু গায়েনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশ কর্তা এবং আইনজীবীদের অনেকেই মনে করছেন, পুলিশের কাছে রাজ্যের নাগরিকেরা এখন দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছেন নবান্নপন্থী এবং নবান্ন-বিরোধী। বাবুল সুপ্রিয়, সুমন মুখোপাধ্যায়রা দ্বিতীয় গোষ্ঠীতে পড়বেন। হাড়োয়া এবং সোনামুখীর অভিযুক্ত দুই বিধায়কই তৃণমূলের। তাই তাঁরা প্রথম গোষ্ঠীর। বাবুল ও সুমনের দলে রয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র, লালগড়ের শিলাদিত্য চৌধুরী, কামদুনির গৃহবধূ মৌসুমী কয়ালরা। অনুব্রত মণ্ডল, মনিরুল ইসলামদের নিয়ে অন্য দলের তালিকাও বেশ দীর্ঘ। আইনজীবী দীপনারায়ণ মিত্র-র কথায়, “আমরা-ওরার এই ভাগ তো আমরা আগেও দেখেছি। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত যেন সেই ভাগ আরও তীব্র হচ্ছে।”

প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা এবং আইনজীবীরা আরও লক্ষ করেছেন, নাগরিকদের মেরুকরণের সঙ্গে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষের মতো অফিসারদের সংখ্যাও বাড়ছে। যাঁরা নবান্ন’র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ। পূর্ব যাদবপুর থানার পূর্বতন অতিরিক্ত অফিসার ইনচার্জ মিলন দাস, রানিগঞ্জ থানার সার্কেল ইনস্পেক্টর বামাপদ দাস এই তালিকায় অর্ণব ঘোষের সঙ্গী। মিলনবাবুই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতার করেছিলেন। বাবুল সুপ্রিয়কে ডেকে পাঠিয়ে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছিলেন বামাপদবাবু।

তবে অতি সক্রিয়তায় আপাতত অর্ণব অন্য সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। নাট্যকার সুমন, সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ, সিপিএম নেতা গৌতম দেব ও সুজন চক্রবর্তীই শুধু নন। অর্ণবের হাতে হেনস্থা হতে হয়েছে গণেশ ঘোষ এবং অঞ্জন ভট্টাচার্যকেও। প্রথম জন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক ছিলেন। অন্য জন হিডকো-র প্রাক্তন জনসংযোগ আধিকারিক। অভিযোগ, দু’জনকেই সারদা-মামলার তদন্তে ডেকে বসিয়ে রাখেন বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান।

গণেশ নিজে অবশ্য এ নিয়ে খুব সতর্ক ভাবেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাকে টানা কয়েক দিন ডেকে পাঠানো হয়েছিল। উনি (অর্ণববাবু) ব্যস্ত ছিলেন। তাই হয়তো অপেক্ষা করতে হয়েছে।”

অর্ণব নিজে মন্তব্য করতে চাননি। বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার ফোন ধরেননি। তবে কলকাতা হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় বলছেন, “আমি রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে মামলা করি। সাম্প্রতিক এই মেরুকরণের সমস্যা বিধাননগর কমিশনারেটের আওতাতেই যেন বেশি হচ্ছে। সারদা থেকে সুমন।” মিলনবাবু মনে করেন, এই মূহূর্তে পুলিশি তদন্তের অভিমুখও দু’ধরনের। এক দিকে ডেকে ডেকে হেনস্থা বা হয়রানি করা। যার আওতায় পড়ছেন সুমন, বাবুল সুপ্রিয়রা। অন্য দিকে শাসক দলের অঙ্গুলিহেলনে দলীয় নেতা-কর্মী বা দলঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকা। যা অনুব্রত, মনিরুলদের ক্ষেত্রে ঘটছে বলে অভিযোগ।

সদ্য প্রাক্তন এক ডিজি পর্যায়ের অফিসারের মন্তব্য, “খুনের অভিযুক্ত এক তৃণমূল নেতা যখন মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন ওই মামলার তদন্তকারী অফিসারদের কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা রাজ্য প্রশাসনের ভেবে দেখা দরকার।” ওই প্রাক্তন পুলিশ কর্তা নাম না করে মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী সভায় উপস্থিত বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের কথাই বলতে চেয়েছেন।

ওই সদ্যপ্রাক্তন কর্তার কথায়, ‘‘এ সব দেখেই অর্ণব ঘোষের মতো অফিসারেরা উৎসাহিত হন। প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধরে অভিযুক্ত কিংবা সিপিএম সমর্থকদের উপরে গুলি চালানোয় অভিযুক্ত বিধায়কদের পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদই করে না।” দুই তৃণমূল বিধায়ক, সোনামুখীর দীপালী সাহা এবং হাড়োয়ার ঊষারানি মণ্ডল তাই এখনও অধরা।

রাজ্য পুলিশের এই অবস্থা দেখে রীতিমতো ব্যথিত কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, “আজকের এই পুলিশকে বড় অসহায় দেখাচ্ছে। ওদের অবস্থা অনেকটা কাগুজে বাঘের মতো।” তুষারবাবুর আক্ষেপ, “সব আমলেই দেখা যাচ্ছে, সৎ-নির্ভীক অফিসারদের সঠিক ভাবে কাজে লাগানো হয় না। হয় পুলিশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, নয়তো তাঁদেরও হেনস্থা করা হয়।”

অনেকেরই মনে পড়েছে, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের তদন্ত করার পুরস্কারে সরতে হয়েছিল লালবাজারের তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনকে। গার্ডেনরিচে কনস্টেবল তাপস চৌধুরী খুনের মামলায় শাসক দলের অভিযুক্তদের ধরার ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে অপসারিত হয়েছিলেন তৎকালীন পুলিশ কমিশনার আর কে পচনন্দা। সুতরাং পুলিশ-প্রশাসনের অভ্যন্তরেও এই ধারণা জাঁকিয়ে বসছে যে, চাকরি বাঁচাতে অর্ণব ঘোষেদের দলে নাম লেখানো ছাড়া গতি নেই। পুলিশের বর্তমান শীর্ষ কর্তাদের অনেকেই ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করছেন, শাসকের নির্দেশে তাঁদের অনেক কাজ বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। উপর মহলের চাপের কাছে মাথা নোয়াতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে তাঁদেরও হাত-পা বাঁধা। কর্তাদের বক্তব্য, এই প্রবণতা আগের জমানায় ছিল না এমন নয়। তবে সাম্প্রতিক অতীতে তার প্রাবল্য বেড়েছে।

এ ব্যাপারে প্রশ্ন আইনজীবী এবং প্রাক্তন পুলিশ কর্তাদের অনেকেরই তাই প্রশ্ন, রাজ্যে অঘোষিত জরুরি অবস্থা শুরু হল না কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police action
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE