Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মারের সাগর পাড়ি দিয়েই ওঁরা সাফল্যের কূলে

অভাবের সংসার ও অদম্য জেদ শুক্রবার এই দুইয়েই মিলে গেল কাটোয়া থেকে কোচবিহার। দত্তপুকুরের রিয়া ঘোষের স্বপ্ন কোথাও যেন এক হয়ে গেল মালদহের দেবাশিস মণ্ডলের সঙ্গে! সাড়ে তিন বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন রিয়া। বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। জেঠামশাই জয়দেব ঘোষই সন্তানস্নেহে বড় করেছেন ভাইঝিকে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৪ ০৩:৩১
Share: Save:

অভাবের সংসার ও অদম্য জেদ শুক্রবার এই দুইয়েই মিলে গেল কাটোয়া থেকে কোচবিহার। দত্তপুকুরের রিয়া ঘোষের স্বপ্ন কোথাও যেন এক হয়ে গেল মালদহের দেবাশিস মণ্ডলের সঙ্গে!

সাড়ে তিন বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন রিয়া। বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। জেঠামশাই জয়দেব ঘোষই সন্তানস্নেহে বড় করেছেন ভাইঝিকে। কিন্তু জয়দেববাবুরও তো কায়ক্লেশে চলে সংসার। অন্যের জমিতে চাষ করেই দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে রিয়াকে বড় করেছেন তিনি। রিয়াও ভালবাসার মর্যাদা দিয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিকে নবম স্থান দখল করে।

রোজ দত্তপুকুরের বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে, বারাসতের কালীকৃষ্ণ গার্লস স্কুল সাইকেলে যাতায়াত করতেন রিয়া। পড়াশোনায় জন্য বরাদ্দ থাকত মাত্র তিন ঘণ্টা। তাতেই পদার্থবিদ্যায় ১০০। মোট নম্বর ৪৬৮। আপাতত লক্ষ্য ডাক্তারি পড়া। রিয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বীথিকা দত্ত বলেন, “রিয়ার কষ্টের কাহিনি জানি। আজ ওর জন্য আমরা গর্বিত।” গর্বিত জেঠামশাই জয়দেববাবুও। বলছেন, “রাজ্যে মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এখন মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়াটাই আসল প্রতিবাদ।” তাই যত কষ্টই হোক, ভাইঝিকে ডাক্তারি পড়াতে চান তিনি।

উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী কাটোয়ার সৌরভ পালের বাড়িতে এখনও টিভি নেই। সামান্য জমির ফসল বিক্রি করে সংসার চালান তাঁর বাবা। বাড়িতে বিনোদন বলতে একটা রেডিও! মার্কশিটে অবশ্য কোনও অভাব রাখেননি সৌরভ। মোট নম্বর ৪৭৫। অঙ্ক আর রসায়ন, দু’টোতেই ১০০-য় ১০০! “সৌরভ দেখিয়ে দিল, মেধাকে আটকানো যায় না,” বলছেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। সৌরভের স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন সৌরভ। পাশে পেয়েছিলেন কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে আছে। সেই যুদ্ধে কাউকে পাশে পান কি না, সে-দিকেই তাকিয়ে সৌরভ।

অসাধারণ ফল করেও ডাক্তার হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন নলহাটি বাণীওড় গ্রামের সুব্রত মণ্ডল। উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৬৩ নম্বর পাওয়ার পরে তাই বিকল্প ভবিষ্যৎও ভেবে রেখেছেন তিনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়তে চান। কিন্তু ছোট ছেলের সেই স্বপ্ন পূরণ নিয়েও সংশয়ে বাবা মোহনরায় মণ্ডল। যাঁর আয়ের উৎস মূলত ১০০ দিনের প্রকল্পে ঘাম ঝরানো।

মালদহের কাশিমপুরের দেবাশিস মণ্ডলের বাবা মাধ্যমিকের পরেই ছেলের পড়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। দেবাশিসের বাবা ঠিকাদারের অধীনে সামান্য পাম্পকর্মী। সংসারে অনটনের ছবি বড়ই প্রকট। তবে পড়া বন্ধ হয়নি দেবাশিসের। স্কুলের এক শিক্ষকের সৌজন্যে। ছাত্রকে নিজের বাড়িতে রেখেই পড়িয়েছেন শিক্ষক উদয়শঙ্কর ঘোষ। দেবাশিস সেই ভালবাসার মর্যাদা দিয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিকে ৪১৯ পেয়ে। উদয়শঙ্করবাবু বলছেন, “দেবাশিসের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারলে তবেই আমার জীবন সার্থক।” দেবাশিস তাকিয়ে জয়েন্টের ফলের দিকে। লক্ষ্য ডাক্তারি পাশ করে গ্রামের সেবা করা।

বিজ্ঞানের এত পড়ুয়ার পাশাপাশি কলা বিভাগের উজ্জ্বল মুখ কোচবিহারের দক্ষিণ ভাড়ালির রঞ্জিত বর্মণ। মাধ্যমিকের পরে অর্থাভাবেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারেননি তিনি। তবে সিতাই হাইস্কুলের কলা বিভাগের ছাত্র রঞ্জিতের নম্বর দেখে অনেক বিজ্ঞানের পড়ুয়াও লজ্জা পাবেন। দিনমজুর বাবার টানাটানির সংসারে কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে রঞ্জিত পেয়েছেন ৪২৫। স্কুলের বিভিন্ন শিক্ষক ছাড়াও তিন জন গৃহশিক্ষক তাঁকে সাহায্য করতেন। কিন্তু টাকা নিতেন না। মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে রঞ্জিত জানালেন, কোচবিহারের কলেজেই ইংরেজি নিয়ে পড়তে চান। রঞ্জিতের এমন ফলে আনন্দিত তাঁর পড়শিরাও। কিন্তু সেই আনন্দে ষোলো আনা শরিক হতে পারছেন না বাবা ধনঞ্জয় বর্মণ। দিনমজুর ধনঞ্জয়বাবুর চিন্তা, এখন ছেলের বি.এ পড়ার খরচ জোগাবেন কী ভাবে।

অভাব নয়, পাঠভবনের শ্রেয়ন চট্টোপাধ্যায়ের পথের পাথর সেরিব্রাল পলসি। সেই ছোটবেলা থেকেই। সঙ্গে হাইপোগ্লাইসেমিয়া। অসুখের দাপটে শ্রেয়নের শরীরের বাঁ দিকে ভারসাম্য কম। হাতের লেখার গতি শ্লথ। তাই বাড়তি সময় লাগে পরীক্ষায়। বড়সড় সমস্যা রয়েছে চোখেও। এই সব সমস্যা নিয়েই শুক্রবার কলা শাখায় ৭২ শতাংশ নম্বর পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলেন শ্রেয়ন। এ বার তাঁর ইচ্ছে ইংরেজিতে অনার্স পড়ার। শ্রেয়নের বাবা গৌতমবাবু জানান, শহরের অন্যতম নামী স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়েছিলেন ছেলেকে। সেই স্কুল পরামর্শ দেয়, ছেলে ‘অস্বাভাবিক’। তাই তাঁকে বিশেষ স্কুলে ভর্তি করানো দরকার। গৌতমবাবু এ দিন বলেন, “পাঠভবন শ্রেয়নকে ভর্তির সুযোগ তো দিয়েছেই। সেই সঙ্গে ওখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা ওকে গড়ে তুলেছেন অনেক ভালবাসায়। তার জন্য ওঁদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ।”

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

higher secondary result
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE