Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

রাজনীতি অটুট রেখে বাংলার জন্য পথ-সন্ধান

নির্বাচনী প্রচারে দু’জনের রাজনৈতিক সংঘাত চরমে উঠেছিল। কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশের পরে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের প্রশ্নে কোনও রাজনীতি চান না। বাংলাকে সাহায্যের বিষয়ে আলোচনার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন তিনি। আজ প্রধানমন্ত্রী মোদীর শপথগ্রহণে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মুকুল রায়কে পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতাও বার্তা দিলেন, রাজনৈতিক বিরোধ যা-ই হোক, তিনিও কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে দরজা বন্ধ রাখতে চান না।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৪ ০৩:২৬
Share: Save:

নির্বাচনী প্রচারে দু’জনের রাজনৈতিক সংঘাত চরমে উঠেছিল। কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশের পরে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের প্রশ্নে কোনও রাজনীতি চান না। বাংলাকে সাহায্যের বিষয়ে আলোচনার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন তিনি। আজ প্রধানমন্ত্রী মোদীর শপথগ্রহণে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মুকুল রায়কে পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতাও বার্তা দিলেন, রাজনৈতিক বিরোধ যা-ই হোক, তিনিও কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে দরজা বন্ধ রাখতে চান না। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকে ঘিরে এই সৌজন্যমূলক পদক্ষেপকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে বিজেপি ও তৃণমূল সূত্রে।

রাষ্ট্রপতি ভবনে মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির হতে আজ সকালেই দিল্লি পৌঁছে যান অমিত ও মুকুল। দিল্লি বিমানবন্দরে নেমে অমিতবাবু বলেন, “সাংবিধানিক প্রয়োজন মেনেই আমরা শপথগ্রহণে এসেছি।” যা থেকেই স্পষ্ট, কেন্দ্র ও রাজ্যের সাংবিধানিক সম্পর্কের মধ্যে তৃণমূল ও বিজেপি-র রাজনৈতিক বিরোধিতাকে জায়গা দিতে চাইছে না রাজ্য সরকার।

প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে পি চিদম্বরমইউপিএ সরকারের জমানায় এই দুই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দিল্লিতে এসে বারবার বৈঠক করেছেন পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিতবাবু। মুখ্যমন্ত্রী মমতার নির্দেশে কেন্দ্রের কাছে দরবার করেছেন, যাতে পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা মকুব করে আর্থিক সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও গত তিন বছরে রাজ্যের জন্য আর্থিক প্যাকেজ আদায় করতে পারেনি তৃণমূল সরকার। মোদী কিন্তু নির্বাচনের পরে জানিয়ে দিয়েছেন, গত তিন বছরে মমতা কেন্দ্রের কাছে যে সাহায্য চেয়েছেন, তার থেকে অনেক বেশি সাহায্য করতে চান তিনি।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত ৭ দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা আর মোদীকে নতুন করে আক্রমণ করে কোনও মন্তব্য করেননি। মোদী বনাম মমতার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের উত্তাপ এখন অনেকটাই কমে এসেছে। বিজেপি নেতারা বলছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেডের জনসভাতেই মোদী আশ্বাস দিয়েছিলেন, কেন্দ্রে সরকারে এলে তিনি বাংলার সরকারকে সাহায্য করবেন। তার পরে ভোট-প্রচারে তৃণমূল নেত্রীকে আক্রমণ করলেও ভোট মিটে যেতেই ফের একই কথা বলেছেন তিনি। মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এ বার অমিতবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে পশ্চিমবঙ্গকে সাহায্যের রাস্তা খুঁজবেন বলে বিজেপি সূত্রের ইঙ্গিত।

প্রশ্ন হচ্ছে: এত দিন ইউপিএ সরকার যা করতে পারেনি, নতুন সরকার তা করবে কী ভাবে? পশ্চিমবঙ্গের ঋণের সমস্যা নিয়ে চিদম্বরমের যুক্তি ছিল, এই বিষয়টি চতুর্দশ অর্থ কমিশন খতিয়ে দেখছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে আলাদা ভাবে পশ্চিমবঙ্গকে সাহায্য করার সুযোগ খুবই কম। অর্থ কমিশনের সূত্র মেনেই ভবিষ্যতে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে কর বাবদ আয় বণ্টন হবে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও পঞ্জাবের মতো তিনটি ঋণগ্রস্ত রাজ্যের জন্য কী করা যায়, তা পৃথক ভাবে খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে ওয়াই ভি রেড্ডির নেতৃত্বাধীন অর্থ কমিশনকে। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, নতুন সরকার অর্থ কমিশনকে ঋণগ্রস্ত রাজ্যগুলির জন্য বাড়তি কোনও দায়িত্ব দিতে পারে। কমিশনের সুপারিশ কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবস্থা হিসেবে অর্থ মন্ত্রকও কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কোন কোন পথে কেন্দ্র রাজ্যকে সাহায্য করতে পারে, সে বিষয়ে অমিতবাবু বেশ কিছু সুপারিশ করেছিলেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে জেটলি সেই সব সুপারিশ খতিয়ে দেখবেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা আজও মন্তব্য করেছেন, রাজ্যের আদায়-করা করের টাকা সবই কেন্দ্র নিয়ে চলে যায়! কেন্দ্রের নতুন সরকার রাজ্যকে সাহায্য করার জন্য পথ খুঁজলে মমতার সরকারেরও যে সে দিকে তীক্ষ্ম নজর থাকবে, তা সহজেই অনুমেয়।

তার মানে অবশ্য এই নয় যে, তৃণমূল ও বিজেপি-র মধ্যে রাজনৈতিক লড়াই শেষ হয়ে যাচ্ছে। বরং উল্টোটাই! লোকসভায় রাজ্য থেকে ১৭% ভোট ও দু’টি আসন জিতে নেওয়ার পরে বিজেপি এখন রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ! আরএসএস-ও পশ্চিমবঙ্গে সাংগঠনিক জমি শক্ত করতে চাইছে। সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত নিজের সচিব প্রশান্ত ভট্টকে কলকাতার দায়িত্বে বসিয়ে দিয়েছেন। আগামী বছর কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। তার পরেই ২০১৬ সালে বিধানসভার ভোট। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ রাজ্যপালের কাছে ১৭টি পুরসভার আসন্ন নির্বাচন ঠিক সময়ে করার দাবিও জানিয়ে এসেছেন। যেখানে সিপিএমের রক্তক্ষরণ অব্যাহত এবং কংগ্রেসের করুণ দশা, সেখানে বিজেপি চাইছে তৃণমূলের বিপরীতে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসতে। বিজেপি নেতা এবং নতুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের কথায়, “এই অবস্থায় আমরা তৃণমূলের সম্পর্কে রাজনৈতিক ভাবে কোনও রকম নরম অবস্থান নেব, তা হতেই পারে না। বরং, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পরিবর্তন এলেও আসলে যে কোনও উন্নয়ন হয়নি, সেটাই মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।” ভবিষ্যতের রণকৌশল তৈরির জন্য বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত নেতা সিদ্ধার্থনারায়ণ সিংহ কাজও শুরু করে দিয়েছেন।

এক দিকে যখন বিজেপি রাজ্যে রাজনৈতিক জমি দখলের চেষ্টা করবে, তখন মমতার সরকারকে কেন্দ্রের কাছ থেকে উন্নয়নের জন্য আর্থিক সাহায্য আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। কী হবে তৃণমূল নেতৃত্বের রণকৌশল? শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় আনন্দবাজারকে বলেন, “দলের মধ্যে আলোচনা করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কোনও ব্যক্তিবিশেষ এটা ঠিক করবে না। আমাদের দলে সবকিছুই আলোচনার মাধ্যমে সামগ্রিক ভাবে সিদ্ধান্ত হয়।” এ ক্ষেত্রেও তা-ই হবে বলে মুকুলবাবু জানিয়েছেন।

রাজ্য সরকারের মূল অভিযোগ বাম জমানায় বেড়ে ওঠা বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে। যার পরিমাণ এখন ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বলে রাজ্য সরকারের দাবি। বছরে এর জন্য ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি সুদ মেটাতে হয়। ফলে উন্নয়ন খাতে খরচ করার জন্য প্রায় কোনও অর্থই পড়ে থাকে না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবেদন ছিল, তিন বছর রাজ্য থেকে ঋণের উপরে সুদ আদায় স্থগিত (মোরাটরিয়ম) রাখা হোক। ঋণের কাঠামো পুনর্বিন্যাস, ঋণগ্রস্ত রাজ্য হিসেবে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের জন্যও দাবি জানিয়েছে রাজ্য সরকার।

নতুন কেন্দ্রীয় সরকার কতখানি ইতিবাচক মনোভাব নেবে? বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, মোদী নিজেও বরাবর রাজ্যের হাতে আরও বেশি আর্থিক ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। মোদীর পাশাপাশি এ বার জেটলি ও রাজনাথ সিংহ, দু’জনেই পশ্চিমবঙ্গের সমস্যার প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব নিতে চান। রাজনাথ ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেডের সভাতেই মমতার আর্থিক দাবিদাওয়ার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন। তৃণমূল নেত্রীর তিনিও বাংলার কোষাগারকে ‘ফোঁপরা’ করে দেওয়ার জন্য সিপিএমকেই দায়ী করেছিলেন। এর পরে রামপুরহাটে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে রাজনাথ আশ্বাস দিয়েছিলেন, কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে বাংলার জন্য বিশেষ প্যাকেজের কথা বিবেচনা করবেন। সেই বিবেচনার সময় শুরু হয়ে গেল আজ থেকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE