নিজের দফতরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।
রাত পোহাতেই মত বদলে গেল!
নতুন দফতরের দায়িত্ব নিয়ে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বুধবার রাতে জানিয়েছিলেন, কলেজে স্নাতকস্তরে ভর্তিতে অনলাইন প্রক্রিয়াই চালু থাকবে। তবে প্রক্রিয়াগত কিছু রদবদলের বিষয়ে আলোচনা দরকার বলে তিনি মত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালেই শিক্ষা দফতর উল্টো পথে হাঁটল। পার্থবাবু জানিয়ে দিলেন, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে সব কলেজে অনলাইন ছাত্রভর্তি বাধ্যতামূলক নয়।
রাতারাতি মন্ত্রীর এ হেন এই মতবদলের পিছনে রাজনৈতিক চাপকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে। তাঁদের মতে, এটা কার্যত শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের কাছে সরকারের নতি স্বীকারেরই নামান্তর।
পার্থবাবু অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল, ছাত্রভর্তিতে স্বচ্ছতা বজায় রাখার লক্ষ্যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত নীতি মেনে অনলাইন ভর্তির পথে সরকারই কয়েক কদম এগিয়েছিল। তা থেকে পিছিয়ে আসার এই সিদ্ধান্তে সরকারেরই মুখ পুড়ল বলে মনে করছে শিক্ষামহলের একাংশ। বিশেষত প্রশ্ন উঠেছে, সদ্য বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু মঙ্গলবার ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে অনলাইন ছাত্রভর্তির ঘোষণা করার এক দিন পরেই নতুন শিক্ষামন্ত্রী কেন উল্টো পথে গেলেন?
এবং এই পরিস্থিতিতে ছাত্রভর্তিতে স্বচ্ছতা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা হবে কী করে, কিংবা ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের চাপাচাপি বন্ধ হওয়ার নিশ্চয়তাই বা কে দেবে, সেই সব প্রশ্নও প্রকট হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন কলেজে পড়ুয়া ভর্তির প্রক্রিয়ায় যাতে স্বচ্ছতা বজায় থাকে, মূলত সেই লক্ষ্যে অনলাইন পদ্ধতি চালুর কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের শিলান্যাস অনুষ্ঠানেও তা জানিয়েছিলেন। বস্তুত অনলাইন পদ্ধতিতে যে কাজের দক্ষতা বাড়ে, মমতা সরকারেরই অন্যান্য দফতর সেই নজির তৈরি করেছে। যেমন অনলাইন রাজস্ব আদায়ে সুফল পেয়েছে অর্থ দফতর, কর আদায় বাড়িয়েছে পুরসভা, ই-টেন্ডার ডেকে পূর্ত দফতর কাজে গতি এনেছে। পাশাপাশি গত বছর কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইনে ভর্তির পর্ব চুকিয়ে ফেলে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় দেখিয়ে দিয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছাত্রভর্তিতেও স্বচ্ছতা আনা সম্ভব।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ব্রাত্যবাবুও উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁর ঘোষিত নীতিতে ভর্তি-প্রক্রিয়ায় ১০০ শতাংশ স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা না-থাকলেও প্রতিরোধের একটা দেওয়াল তোলার চেষ্টা ছিল। পার্থবাবু তাও রাখলেন না বলে আক্ষেপ শোনা গিয়েছে শিক্ষামহলের আনাচে-কানাচে। মঙ্গলবার যখন তাঁকে শিক্ষা থেকে সরিয়ে পর্যটনের মন্ত্রী করার তোড়জোড় চলছে, ব্রাত্যবাবু তখন সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সব কলেজের জন্য আবেদনকারী পড়ুয়াদের বিষয়-ভিত্তিক তালিকা (কাউন্সেলিং লিস্ট) তৈরি হবে, যা পাঠানো হবে কলেজের কাছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও থাকবে। তবে ভর্তি হতে হবে কলেজে গিয়ে। তখন অবশ্য ছাত্র সংসদের তরফে পড়ুয়াদের বাধাদানের একটা চেষ্টা হতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু সেটুকু বাদ দিলে ব্রাত্যবাবু সার্বিক ভাবে অনলাইন ভর্তি চালুর যে চেষ্টা শুরু করেছিলেন, শাসকদলের ছাত্র সংগঠনই (তৃণমূল ছাত্র পরিষদ, সংক্ষেপে টিএমসিপি) তাতে বেঁকে বসে। সংগঠন-সূত্রের খবর, তাদের তিন নেতা তৃণমূলের একেবারে প্রথম সারির এক নেতার কাছে গিয়ে পদ্ধতিটি বাতিল করার জন্য দরবার করেন। পার্থবাবুর এ দিনের সিদ্ধান্তে তারই ছায়া দেখছে দলের একাংশ।
অথচ বুধবার রাতে পার্থবাবুই জানিয়েছিলেন, স্নাতকে ছাত্রভর্তি হবে অনলাইনে, যার পদ্ধতি স্থির করতে বৃহস্পতিবার সকালে তিনি বৈঠকে বসবেন উচ্চশিক্ষা-কর্তাদের সঙ্গে। এ দিন ওই বৈঠকের পরেই শিক্ষামন্ত্রীর বয়ান বেমালুম বদলে যায়। পার্থবাবু জানান, যে সব কলেজ পারবে, তারা অনলাইনে ভর্তি করবে। সর্বত্র অনলাইন পদ্ধতি চালু করার প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত দ্রুত সেরে ফেলা হচ্ছে বলে জানিয়েও নতুন শিক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। নবান্ন-সূত্রের ইঙ্গিত, মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শেই পার্থবাবুর এই নয়া পদক্ষেপ।
আর তার জেরে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অধীনস্থ সব কলেজে স্নাতকে অনলাইন ছাত্রভর্তি সংক্রান্ত যে নির্দেশিকাটি উচ্চশিক্ষা দফতর ফেব্রুয়ারিতে জারি করেছিল, সরকার তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, পদ্ধতিতে পরিকাঠামোগত সমস্যা ও প্রযুক্তিগত খামতি থেকে যাওয়ার কারণে এ বছর সর্বত্র অনলাইন ভর্তি চালু করা যাচ্ছে না। তাঁর দাবি, “সরকার অনলাইন ছাত্রভর্তি চালু করতে বদ্ধপরিকর, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু আমরা ছাত্রসমাজের সমস্যা তৈরি করতে চাই না।”
তাই প্রযুক্তিগত সমস্যা মিটিয়ে, পুরোদস্তুর প্রস্তুতি নিয়ে এই রাস্তায় নামতে চাইছেন রাজ্যের প্রাক্তন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী পার্থবাবু। কলেজে অনলাইনের সুযোগ না-থাকলে নিকটবর্তী কলেজ থেকে সাহায্য নিয়ে কাজ চালানোর যে পথ উচ্চশিক্ষা দফতর আগে বাতলেছিল, নতুন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তা-ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তিতে নিজের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝলাম, কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইন ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় সফ্টওয়্যার তৈরি হয়নি। যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক মারফত ছাত্রছাত্রীদের টাকা জমা দেওয়ার কথা ছিল, তাদের সব শাখার সঙ্গে যোগাযোগও গড়ে ওঠেনি।” উচ্চশিক্ষা-সচিব বিবেক কুমার এ দিন জানান, অনলাইন ভর্তি বা অনলাইন আবেদনের বন্দোবস্ত করতে না-পারলে কলেজই সাবেক পদ্ধতিতে ফর্ম বিক্রি করে ও জমা নিয়ে পড়ুয়া ভর্তি করবে। এই মর্মে বার্তা দিয়ে দফতর নতুন নির্দেশিকাও জারি করেছে।
তবে উচ্চশিক্ষা দফতর ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে দাবি, সফ্টওয়্যারের অভাব কিংবা ব্যাঙ্কের শাখার সঙ্গে যোগাযোগহীনতার যে যুক্তি মন্ত্রী দিচ্ছেন, তা ধোপে টেকে না। এই মহলের অভিযোগ, টিএমসিপি-র আপত্তিই সিদ্ধান্ত বদলের অন্যতম কারণ। টিএমসিপি নেতৃত্ব অভিযোগ মানতে চাননি। অন্য দিকে এসএফআই বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। বাম ছাত্র সংগঠনটির রাজ্য সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস বলেন, “এই প্রক্রিয়া চালু করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। কিন্তু যেখানে শিক্ষামন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে আসেন আরাবুল ইসলাম, সেখানে অনলাইন ভর্তি চালু হতে পারে না।” তাঁর দাবি, বাম আমলেই অনেক কলেজে অনলাইন ছাত্রভর্তি চালু হয়েছে, তৃণমূল জমানায় পরিস্থিতির কোনও অগ্রগতি হয়নি। “এখন প্রযুক্তি আরও উন্নত। সরকার সেটাকেই ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ভাবে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিল। তা হলে পিছিয়ে এল কেন?” প্রশ্ন দেবজ্যোতির। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কৌস্তুভ বাগচীর কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী তো বেকারদের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন! উনি এ ভাবেই টাকা নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন অনেককে।”
বস্তুত ছাত্রভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের চাপাচাপিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েগুলি অতিষ্ঠ। উচ্চশিক্ষা দফতরও চেয়েছিল অত্যাচারে দাঁড়ি টানতে। তাই কেন্দ্রীয় ভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও সেই মতো এগিয়েছে। তাদের দাবি, অধীনস্থ কলেজগুলির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে, পেশাদারি সংস্থাকে সফ্টওয়্যার তৈরির দায়িত্ব দিয়ে, আধিকারিকেরা প্রয়োজনে সপ্তাহভর পরিশ্রম করে ব্যবস্থাটি মোটামুটি ভাবে পাকা করে ফেলেছিলেন। মঙ্গলবার প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে সব বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছিল, অনলাইন ভর্তির প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে।
এমতাবস্থায় সরকার নিজেরই ঘোষিত নীতি থেকে সরে আসায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তি বিস্ময় গোপন করতে পারেননি। তাঁদের বক্তব্য, সরকার চাইলে প্রক্রিয়ায় নজরদারির জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়তে পারত। সফ্টওয়্যার-বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, তিন-চার ঘণ্টাতেও একটা সফ্টওয়্যার তৈরি করে ফেলা যায়। কাজেই ফেব্রুয়ারিতে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে তিন মাসেও সফ্টওয়্যার তৈরি করা গেল না মন্ত্রীর এ হেন যুক্তি ওঁদের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্যই ঠেকছে।
নতুন নির্দেশিকার প্রতিক্রিয়াও এ দিন টের পাওয়া গিয়েছে। কী রকম?
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, এ বছর তাদের কেন্দ্রীয় ভাবে ছাত্রভর্তি নিশ্চিত নয়। উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার বলেন, “অনলাইন ভর্তি প্রক্রিয়া নির্ভুল ভাবে সম্পন্ন করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু আজই নতুন নির্দেশিকা পেলাম। সোমবার সকলের সঙ্গে আলোচনা করে এ বছরের পদ্ধতি স্থির হবে।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য (শিক্ষা) ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নতুন নির্দেশিকা নিয়ে আধিকারিকদের সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষা-ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তা দেওয়া হয়েছে। নতুন নির্দেশিকার কথা কলেজগুলোকেও জানানো হয়েছে।”
এ দিকে আজ, শুক্রবার উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ। উচ্চশিক্ষা দফতরের নির্দেশ, ১০ জুনের মধ্যে ছাত্রভর্তির প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন কলেজ নতুন ভাবে ভর্তির বন্দোবস্ত করছে। কোথাও সার্ভিস প্রোভাইডার দিয়ে অনলাইন ভর্তির তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
আবার কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে আবেদনপত্র ছাপার জন্য হুড়োহুড়ি। মানে, ঘুরে-ফিরে সেই আগের জায়গাতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy