বিশিষ্ট লেখক ও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু প্রয়াত হয়েছেন। রবিবার বিকেল ৫টা ১০ মিনিট নাগাদ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে তাঁর জীবনাবসান হয়। বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। কয়েক বছর ধরে বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন তিনি। ৩০ জুন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তাঁর বড় ছেলে সুদীপ জানান, আজ, সোমবার হাওড়ার শিবপুর শ্মশানে শঙ্করীবাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
শঙ্করীবাবু দীর্ঘদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে লেখক-চিন্তাবিদ হিসেবে নিজস্বতার ছাপ রেখে গিয়েছেন তিনি। রম্য ভঙ্গিতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ চর্চা থেকে ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখি শঙ্করীবাবু বিচিত্রচারী। ষাটের দশকে বাংলা খবরের কাগজে ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচ নিয়ে প্রতিবেদন লেখার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। ক্রিকেট নিয়ে তাঁর বইও আছে ‘লাল বল লারউড’। আবার তিনিই সাত খণ্ডে ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’-এর মতো গবেষণালব্ধ বই লিখতে দীর্ঘ কাল কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
৫০টির বেশি বই, অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন শঙ্করীবাবু। পেয়েছেন আনন্দ, সাহিত্য অকাদেমি-সহ অজস্র পুরস্কার। ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ ছাড়াও তাঁর স্মরণীয় গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘নিবেদিতা লোকমাতা’ (চার খণ্ড), ‘সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র’ (দুই খণ্ড), ‘রসসাগর বিদ্যাসাগর’, ‘সহাস্য বিবেকানন্দ’, ‘চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি’ ইত্যাদি।
শংকর-এর সংযোজন:
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-নিবেদিতা জ্ঞান সঞ্চয়নের বৃহত্তম টাইটানিক জাহাজটি রবিবার বিকেল ৫টায় প্রিয়জনদের সমস্ত প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করে কালসমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
বিগত এক শতকে যাঁরা বিপুল নিষ্ঠায় সব বাধাবিপত্তি নস্যাৎ করে অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দকে বিশ্বাস্য বিবেকানন্দে রূপান্তরিত করার সাধনায় মগ্ন ছিলেন, তাঁদের অগ্রগণ্য শঙ্করীপ্রসাদ যে আর লিখবেন না, ভাবতে ইচ্ছে করে না। এক মার্কিন পণ্ডিতকে ওঁর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলাম, তিনি মার্কিন গবেষিকা মেরি লুই বার্কের ইন্ডিয়ান এডিশন। সাহেব সবিনয় উত্তর দিলেন, আমি তো বলে বেড়াচ্ছি, বার্ক হচ্ছেন শঙ্করীপ্রসাদের আমেরিকান এডিশন।
শঙ্করীপ্রসাদকে প্রথম দেখি বাল্যবয়সে, ১৯৪২ সালে। হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে তিনি তখন আমার থেকে তিন ক্লাস উঁচুতে পড়েন। তখন তিনি রবীন্দ্র-অনুরাগে বিভোর। আমাদের বলতেন, ‘অনাদি অনন্ত কালকে সীমায়িত করতে হবে আপন প্রাণের প্রবর্তনায়!’
এক দিন এক বিখ্যাত সাহিত্যিক দুঃখ করলেন, বিবেকানন্দের প্রামাণ্য জীবনী এখনও লেখা হয়নি। এ কাজ করার দায়িত্ব তাঁর নামাঙ্কিত ইস্কুলের কোনও ছাত্রকে নিতে হবে। সেই দায়িত্বটাই এক দিন শঙ্করীপ্রসাদ বসু কাঁধে তুলে নিলেন। এবং সমস্ত জীবন ধরে সেই কাজ করে গেলেন।
অথচ তাঁর আরও দু’-একটা দুর্বলতা ছিল। মধ্যযুগের কবি ও কাব্য এবং ক্রিকেট-সাহিত্য। বাংলার নেভিল কার্ডাস হওয়ার দুর্লভ সম্ভাবনাকে হাতে পেয়েও নিজেকে বিবেকানন্দ-চরণে নিবেদন করলেন তিনি। কয়েক দশক ধরে যে-অবিশ্বাস্য সাধনা করলেন, তার তুলনা এ দেশে নেই।
শঙ্করীপ্রসাদের সব প্রচেষ্টার মধ্যেই ছিল অনন্য রসবোধ! বলতেন, ‘স্বামীজির ফচকেমি ভাবটাই আমায় গোড়ার দিকে টেনেছে। এই রসবোধই তাঁকে বিশ্ববিজয়ে সাহায্য করেছে।’ এই রসবোধের রহস্যময় চাবিকাঠিটা শিক্ষক শঙ্করীপ্রসাদ অনুগ্রহ করে আমাকেও দান করেছিলেন। আমার সাহিত্যজীবনটা পুরোপুরি তাঁরই সৃষ্টি। ‘চৌরঙ্গি’ উৎসর্গ করে লিখেছিলাম, আমার সাহিত্যজীবনের প্রযোজক, পরিচালক ও সুরকার শঙ্করীপ্রসাদ বসুকে। বাংলাদেশে ‘বুক পাইরেসি’র কথা উঠলেই বলতেন, আমি কিন্তু ওদের খুব ভালবাসি ওরা লেখকের রয়্যালটি না-দিক, উৎসর্গপত্র থেকে আমার নামটা কখনও বাদ দেয় না। রসবোধের সঙ্গে মিলন হয়েছিল, তুলনাহীন বাংলা স্টাইলের, সেই সঙ্গে বিপুল নিষ্ঠা, অশেষ ধৈর্য ও সততার। তারও উপরে দাঁড়িয়ে ছিল ভক্তি--- যা ঐতিহাসিক ও বিশ্লেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসুকে অনন্য এক বৈশিষ্ট্য দিতে সক্ষম হয়েছিল। কাজটা বড়ই কঠিন।
শঙ্করীপ্রসাদের আজীবন সাধনা ও সৃষ্টি প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছে হয়, এক যুগের অবসান হল। এ যুগের নমস্যরা কী পাব তার হিসেব না-করেই সমস্ত জীবন ধরে শুধু দিয়েই গেলেন। দিয়েই গেলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy