Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
নাকাল দলে চড়ের চোট

অভিষেকের উপর চড়াও যুবক, গণধোলাইয়ে জবাব সমর্থকদের

দলীয় সভায় বক্তব্য রাখতে উঠেছিলেন যুব তৃণমূলের সভাপতি তথা মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার অছিলায় মঞ্চে উঠে এক যুবক সপাটে চড় কষিয়ে দিলেন তাঁর গালে! মারলেন ঘুষিও। রাজ্য রাজনীতিতে নজিরবিহীন এই ঘটনার সাক্ষী রইল পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুর। সারদা-কাণ্ডে শাসক দল এখন কোণঠাসা। দলের মধ্যে অস্থিরতা চরমে। সঙ্কট মুহূর্তে দল পরিচালনার ভার নিজেই তুলে নিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩৫
Share: Save:

দলীয় সভায় বক্তব্য রাখতে উঠেছিলেন যুব তৃণমূলের সভাপতি তথা মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার অছিলায় মঞ্চে উঠে এক যুবক সপাটে চড় কষিয়ে দিলেন তাঁর গালে! মারলেন ঘুষিও। রাজ্য রাজনীতিতে নজিরবিহীন এই ঘটনার সাক্ষী রইল পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুর।

সারদা-কাণ্ডে শাসক দল এখন কোণঠাসা। দলের মধ্যে অস্থিরতা চরমে। সঙ্কট মুহূর্তে দল পরিচালনার ভার নিজেই তুলে নিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে সারদায় সিবিআই তদন্তের ফাঁস যত চেপে বসছে, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের একাধিপত্য খর্ব করে সাংগঠনিক নানা গুরুদায়িত্বে অভিষেককে তুলে আনছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই রকম টালমাটাল পরিস্থিতিতে দলীয় মঞ্চে ‘যুবরাজে’র উপরে হামলা শাসক দলের অভ্যন্তরে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। ঘটনাচক্রে, যে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম মমতাকে রাজ্যে ক্ষমতার আসনের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল, তারই অদূরে চণ্ডীপুরে রবিবার বেনজির হেনস্থার মুখে পড়তে হল ভাইপো অভিষেককে!

পশ্চিমবঙ্গে এর আগে নানা ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন নেতা-মন্ত্রীরা। মন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখতে হয়েছে, ‘গো ব্যাক’ শুনতে হয়েছে, বিক্ষোভের মুখে পড়ে মাঝরাস্তা থেকে ফিরেও আসতে হয়েছে। আয়লার ত্রাণ নিয়ে বিক্ষোভের জেরে শাসক দলের বিধায়ককে গায়ে কাদা মাখিয়ে হেনস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষোভের কারণ যা-ই হোক, মঞ্চে উঠে শাসক দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা তথা সাংসদের গালে চড় কষিয়ে আসছেন কেউ, এমন ঘটনা ইতিপূর্বে এ রাজ্য দেখেনি!


রবিবার চণ্ডীপুরের সভায় চড় যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি এবং সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পরে হামলাকারী যুবককে
মারধর তৃণমূল সমর্থকদের (মাঝখানে)। তমলুক জেলা হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হামলাকারী যুবক। নিজস্ব চিত্র, পার্থপ্রতিম দাস

ঘটনার পরেই এ দিন অবশ্য আইন হাতে তুলে নিয়েছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। মঞ্চেই হামলাকারী যুবককে ফেলে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছে তমলুক জেলা হাসপাতালে। পুলিশের উপরেও চড়াও হয়েছিলেন উত্তেজিত তৃণমূল কর্মীরা। শেষমেশ আশপাশের থানা থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। পরে মঞ্চের পিছন দিক থেকে নামিয়ে আনা হয় অভিষেককে। তিনি দ্রুত সভাস্থল ছাড়েন।

প্রশ্ন উঠেছে, হামলাকারী যুবক স্রেফ চড়-ঘুষি মারার পরেই না হয় ধরা পড়ে গিয়েছেন। কিন্তু আরও গুরুতর আক্রমণও তো হতে পারতো? সাংসদ এবং মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর মতো ‘হাই প্রোফাইল ভিআইপি’র সভায় এমন ঘটনা কি নিরাপত্তার বন্দোবস্ত নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে না? পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুকেশ কুমার জৈন অবশ্য বলেছেন, নিরাপত্তায় কোনও গাফিলতি ছিল না। তাঁর বক্তব্য, “সভাস্থলে পর্যাপ্ত পুলিশকর্মী ছিলেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরাও ছিলেন।”

নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ এবং ঘটনার প্রাথমিক উত্তেজনা কাটিয়ে আরও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, কে ওই যুবক? কেনই বা তিনি যুব তৃণমূলের মঞ্চে উঠে আচমকা হামলা চালালেন অভিষেকের উপরে? হাসপাতাল সূত্রে বলা হচ্ছে, আশঙ্কাজনক অবস্থার একটু উন্নতি না হলে যুবকের বয়ান জানা কঠিন। প্রাথমিক ভাবে অবশ্য জানা গিয়েছে, যুবকের নাম দেবাশিস আচার্য। বি টেকের ছাত্র ওই যুবকের বাড়ি তমলুকে। তবে ঘটনায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে গুরুতর জখম অবস্থায় ওই যুবকের কিছু অসংলগ্ন বাক্য। একটি টিভি চ্যানেলে তাঁর যে কয়েকটি বাক্য ধরা পড়েছে, তাতে ওই যুবককে বলতে শোনা যাচ্ছে “চললাম ভারতবাসী, চললাম! হিন্দু ধর্ম রক্ষার্থে আবার জন্ম নেব!” রাতে তৃণমূলের একটি সূত্রে এমন দাবিও করা হয়েছে যে, ওই যুবক নাকি এবিভিপি-র সঙ্গে সংযোগের কথাও বলেছেন। যদিও পুলিশ সুপার জানাচ্ছেন, ওই যুবককে ঠিকমতো জেরার আগে কিছুই বলা সম্ভব নয়।

অভিষেক অবশ্য ঘটনার পরে মুখ খোলেননি। তবে দলের অন্দরেই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে অভিষেকই ওই যুবককে গণপ্রহার থেকে বাঁচিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতে সক্রিয় হলেন না কেন? তাতে তাঁর ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল হতো। অতীতে একাধিক বার চড়-সহ প্রকাশ্যে হেনস্থার শিকার হয়েছেন আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরীবাল। কিন্তু হেনস্থাকারীর বাড়িতে গিয়ে তিনি অন্য রকম বার্তা দিয়ে এসেছেন। অভিষেক অবশ্য দলের অন্দরে বলেছেন, ঘটনার আকস্মিকতা সামলে তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকশো লোক মঞ্চে উঠে ওই যুবককে মারতে শুরু করায় তুমুল বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল। তাতে তিনি আর কিছু বলে উঠতে পারেননি। মঞ্চে উপস্থিত জেলা নেতারাই তাঁকে নামিয়ে নিয়ে যেতে তৎপর হন। ক্ষোভ বহিঃপ্রকাশের ধরন দেখে অভিষেক ‘মর্মাহত’ও বটে।

ঘটনার পরে হামলাকারীকে ‘কাপুরুষের দল’ আখ্যা দিয়ে প্রশাসনের উপরেই তদন্তের ভার ছেড়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু রাতে ওই যুবকের বিবৃতি জানার পরেই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় দাবি করেছেন, “আমরা যে কোনও ধরনের ধর্মীয় বিভাজন, যে কোনও ধর্মের জিহাদিদের বিরুদ্ধে। এখন তো মনে হচ্ছে, কোনও ভাবে তৃণমূলের মোকাবিলা করতে না পেরে এখন অন্য ধরনের ষড়যন্ত্র করে অভিষেকের উপরে কাপুরুষোচিত হামলা চালানো হয়েছে! প্রশাসন পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে। আমরা ঘটনার উপরে নজর রাখছি।” ঘটনা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেলে আজ, সোমবার বিশদে মুখ খুলবেন তৃণমূল নেতৃত্ব। পার্থবাবু প্রশ্ন তুলেছেন, “যাঁরা ঘটনার পরে দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে নানা কথা বলছিলেন, তাঁরা এখন কী বলবেন?”

যুবরাজের হেনস্থাকে তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব বলেই অভিহিত করেছিলেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। পার্থবাবুদের বক্তব্য শুনে রাতে তিনি অবশ্য বলেন, “ওই যুবক গুরুতর জখম। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ তার নিজের বিশ্বাসের কথাই বলে। ওই যুবকের কিছু মন্তব্য থেকে অন্য রকম ইঙ্গিত খোঁজা অর্থহীন।”

বস্তুত, প্রতিপক্ষ দল হলেও অভিষেককে চড় মারার ঘটনাকে সমর্থন করেনি কোনও বিরোধীরাই। তবে তারা খোঁচা দিতেও ছাড়েননি। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম যেমন বলেছেন, “চড় মারার ঘটনা সমর্থন করা যায় না। কিন্তু এই চড় অভিষেকের নয়, আসলে তৃণমূলের গালে পড়েছে! তৃণমূলের মধ্যে যে উষ্মা এখন তৈরি হয়েছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।” ঘটনার নিন্দা করেও প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানের কটাক্ষ, “ওঁর পিসি এক আইপিএসের গালে কালি লাগিয়েছিলেন। এই সংস্কৃতি তৃণমূলের হাত ধরেই রাজ্যে এসেছে। ভাইপোর উপরে তা ব্যুমেরাং হয়ে এসেছে!”

কী ঘটেছিল এ দিন? পুলিশ সুপারের বক্তব্য, “ছবি তুলবে বলে ওই যুবক মঞ্চে উঠেছিল। তার পর আচমকাই এই ঘটনা।” যুবকটির মোবাইল বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ বলছে, কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতি এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের প্রতিবাদে চণ্ডীপুর ফুটবল ময়দানে যুব সমাবেশের শেষ তথা প্রধান বক্তা ছিলেন অভিষেক। তিনি মিনিট দুয়েক বলার পরই ২৫-৩০ ফুট দূরে বসে থাকা নীল টুপি পরিহিত যুবক মোবাইলে অভিষেকের ছবি তুলবে বলে মঞ্চে ওঠেন। নিরাপত্তারক্ষীরা আটকানোর চেষ্টা করলেও বাঁ হাতে মোবাইল নিয়ে এগিয়ে যান। তার পরে হঠাৎই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর বাঁ গালে সপাটে চড় মারেন তিনি। অভিষেক কোনও রকমে টাল সামলানোর চেষ্টা করলে তাঁর বুকের কাছে ঘুষিও মারেন ওই যুবক। মঞ্চে উঠে তৃণমূলের লোকজন যখন হামলাকারীকে পেড়ে ফেলেছেন, বিশ্ৃঙ্খলার মধ্যেই সভাস্থল ছাড়েন যুব সভাপতি।

যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি পদে আগে ছিলেন তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। তাঁকে সরিয়ে প্রথমে সৌমিত্র খাঁ এবং পরে ভাইপোকে যুব সংগঠনের ভার দেন মমতা। সেই অভিষেক যখন শুভেন্দুর জেলায় সভা করছেন, তমলুকের সাংসদ ছিলেন কলকাতায়। ঘটনার নিন্দা করে প্রশাসনের কাছে তদন্ত দাবি করেছেন। হামলাকারী যুবক তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক বলে যদি শেষ পর্যন্ত জানা যায়, তা হলে সন্দেহের তির যে শুভেন্দুর দিকেই পড়তে পারে, তাও অবহিত অধিকারী শিবির। শুভেন্দুর এক ঘনিষ্ঠ নেতা তাই বলেছেন, “এমন আচরণ কে করল বা কারা করাল, জানা দরকার!” বর্ষীয়ান সাংসদ শিশির অধিকারীও বলেছেন, “জীবদ্দশায় এমন ঘটনা দেখিনি!”

বস্তুত, অধিকারী শিবিরের বক্তব্য, চণ্ডীপুরে যুব সমাবেশের কথা তাঁদের জানানোই হয়নি! খড়গপুরে তৃণমূলের কর্মী সম্মেলনের সময় চণ্ডীপুরের বিধায়ক অমিয় ভট্টাচার্যকে (যিনি অধিকারী-বিরোধী শিবিরের বলেই পরিচিত) জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল অভিষেকের এ দিনের সভার কথা। অনাহুত হয়ে সেই সভায় থাকতে চাননি শুভেন্দু ও তাঁর অনুগামীরা। মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র, জ্যোতির্ময় কর, বিধায়ক বিপ্লব রায়চৌধুরী, অমিয়বাবু বা জেলা কার্যকরী সভাপতি অখিল গিরির মতো যাঁরা হাজির ছিলেন, তাঁরা কেউই অধিকারী-শিবিরের লোক বলে খ্যাত নন!

ঘটনার প্রাথমিক অভিঘাতে আরও একটি সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে তৃণমূল শিবিরে। দলের একাংশের প্রশ্ন, অভিষককে ‘শিক্ষা’ দিতে অজ্ঞাতনামা কোনও যুবককে দিয়ে এমন ঘটনা ঘটাতে তৃণমূলেই কোণঠাসা কোনও বড় মস্তিষ্কের কি ভূমিকা আছে? যাতে যুবরাজকেও টলিয়ে দেওয়া যায়, আবার ঘটনার সন্দেহের তির ঘুরে যায় অধিকারী বা তাঁদের বিরোধী পূর্ব মেদিনীপুরের যে কোনও শিবিরের দিকে? দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “কোনও কিছু আন্দাজ করা কঠিন! আবার কিছু উড়িয়ে দেওয়াও কঠিন!”

পরিস্থিতি সামলে অভিষেকের মনোবল বাড়াতে এগিয়ে এসেছেন তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। ডায়মন্ড হারবারের সাংসদের সঙ্গে রাজ্যসভায় দলের মুখ্য সচেতক ডেরেকের সম্পর্ক মসৃণ। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার পরে অভিষেকের প্রতি ডেরেকের টুইট-বার্তা: ‘আমার তরুণ সতীর্থ অনেক শক্ত ধাতুতে তৈরি। আমি জানি, যে লক্ষ্যের প্রতি তোমার বিশ্বাস, এক কাপুরুষের একটা চড় তাতে থাবা বসাতে পারবে না’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE