এক দিকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। অন্য দিকে কংগ্রেসের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। সারদা-তদন্ত নিয়ে তৃণমূলের আক্রমণের মোকাবিলায় একযোগে সরব হলেন কংগ্রেসের দুই কেন্দ্রীয় নেতা। প্রত্যাশিত ভাবেই সারদা-কাণ্ডে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর তদন্ত নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের অভিযোগ ওড়ানোর পাশাপাশি রাজ্য যে ভাবে সিবিআই তদন্তে বাধা দিচ্ছে, তা নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছাড়লেন না তাঁরা। কংগ্রেসের অভিযোগ, সারদা কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার থেকে দোষীদের আড়াল করতেই বেশি সক্রিয় তৃণমূল।
পাল্টা জবাব দিয়েছে তৃণমূলও। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র প্রত্যেকেই কংগ্রেস নেতৃত্বকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তৃণমূলের বক্তব্য, ভোটের মুখে ফায়দা তুলতেই বিরোধীরা একযোগে সারদা নিয়ে হইচই করছে। ইডি তদন্ত নিয়ে চিদম্বরমকে এ দিন ফের ‘চিদুদা’ বলে সম্বোধন করে মমতার মন্তব্য, “চিদুদার নর্থ ব্লকের পাশেই ওদের (ইডি) অফিস। ওদের বলছে, তৃণমূলকে চাপে রাখ। আমরা জোটে যাইনি তো! তাই।”
সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার কয়েক মাস পরেই ঘটনার তদন্তে যুক্ত হয়েছিল ইডি। সম্প্রতি সারদা মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে সমালোচনার মুখে পড়ে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে ইডি। সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী ও এক পুত্রকে হেফাজতে নেয় তারা। ইডি সূত্রে জানানো হয়, তারা প্রায় ৭০ জনকে জেরার জন্য নোটিস পাঠিয়েছে। যার মধ্যে তৃণমূলের এক প্রার্থী-সহ একাধিক নেতার নাম রয়েছে। লোকসভা ভোটপর্বের মধ্যেই ইডি-র এই ভূমিকায় অস্বস্তিতে পড়ে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের বিরুদ্ধে সুর চড়ায় তৃণমূল। প্রথমে মমতা, তার পরে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র-সহ একাধিক নেতা-মন্ত্রী অভিযোগ করেন, চিদম্বরম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইডি-কে ব্যবহার করছেন। সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের চিঠিতে চিদম্বরমের স্ত্রী-র নাম থাকা নিয়েও কংগ্রেস নেতৃত্বকে আক্রমণ করেন মমতা।
এই পরিস্থিতিতে আজ একযোগে দিল্লি এবং কলকাতা থেকে তৃণমূলকে নিশানা করেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। চিদম্বরম দিল্লিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানান, সারদা তদন্তের বিষয়ে তিনি ইডি-কে কোনও নির্দেশ দিচ্ছেন না। তাঁর কথায়, “আমি ইডি-র তদন্তের বিষয়ে কোনও নির্দেশ দিই না।” একই সঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা, “ইডি-র তদন্তের কথা আমি সংবাদপত্র পড়ে জানতে পেরেছি। ইডি-র তরফে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।” যা শুনে অমিত মিত্রের মন্তব্য, “এটা অজ্ঞতার প্রমাণ যে, ইডি কী করছে, তা চিদম্বরম জানেন না!” যদিও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এবং ইডি সূত্রের ব্যাখ্যা, কোনও তদন্তকারী সংস্থাই তাদের তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে দৈনিক রিপোর্ট দেয় না। এ নিয়ে একাধিক ভুল ধারণা রয়েছে। মমতাকে চিদম্বরমের পাল্টা কটাক্ষ, “যাঁরা সারদার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এত উদ্বিগ্ন কেন? সারদা কাণ্ডে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।”
তাঁর স্ত্রী নলিনী চিদম্বরমের সঙ্গে সারদা-যোগের অভিযোগ উড়িয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, “একজন মহিলা শ্রীসেনের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন। পেশাদার আইনজীবী হিসেবে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন নলিনী। এর বদলে তিনি চেকে পারিশ্রমিকও পেয়েছেন। ন’মাস আগেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।” চিদম্বরমের ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, কংগ্রেসের প্রাক্তন মন্ত্রী মাতঙ্গ সিংহের স্ত্রী মনোরঞ্জনার সংস্থায় লগ্নি করেছিলেন সুদীপ্ত। এ বিষয়ে নলিনীর কাছে পরামর্শ নেন মনোরঞ্জনা। তার বদলে নগদ টাকায় নয়, চেকে পারিশ্রমিক নেন নলিনী। এর মধ্যে বেআইনি কিছু
“ইডি-র তদন্তের কথা আমি কাগজ পড়ে
জেনেছি। ইডি কিছু জানায়নি।”
পি চিদম্বরম, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী
“এটা অজ্ঞতার প্রমাণ যে, ইডি কী
করছে, তা চিদম্বরম জানেন না!”
অমিত মিত্র, রাজ্যের অর্থমন্ত্রী
তৃণমূল নেতৃত্ব যখন ইডি-র তদন্তে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র দেখছেন, তখন কলকাতায় কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি প্রশ্ন তুলেছেন, সারদা-কাণ্ডে তদন্তের ভার কেন সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে না। সিঙ্ঘভির যুক্তি, “মুখ্যমন্ত্রী কোনও কিছু লুকোতে চাইছেন বলেই সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করাতে রাজি হচ্ছেন না।” রাজ্যে তৃতীয় দফার ভোটের মুখে আজ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে পাশে বসিয়ে সিঙ্ঘভির অভিযোগ, “স্বচ্ছতার মুখোশ পরে আছে তৃণমূল। সারদার সঙ্গে তৃণমূলের কয়েক জন নেতা, এমনকী ভোটের প্রার্থীও আছেন। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্তকে না বাঁচিয়ে, যারা টাকা মেরেছে তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে!” এ দিন প্রচারে কলকাতায় এসে বিজেপি-র প্রাক্তন সভাপতি নীতিন গডকড়ীও বলেন, “সারদায় বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য রাজ্য সিবিআই তদন্ত চাইছে। বাংলা কেন চাইছে না?”
তৃণমূলও চুপ করে বসে থাকেনি। বালি, সোনারপুর ও টালিগঞ্জে নির্বাচনী প্রচারে মমতা ফের অভিযোগ তুলেছেন, “পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে বিরোধী কংগ্রেস, সিপিএম এবং বিজেপি সারদা নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে। এ বার ভোটেও করছে।’’ রাজ্য সরকার কেন সিবিআই তদন্তে রাজি হচ্ছে না, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মমতা বলেন, “আসলে সিবিআই করে ওরা সমস্ত কিছু বন্ধ করে দিতে চাইছে। সিবিআই হলে আমরাই বেঁচে যাই। আর টাকা ফেরত দিতে হবে না! কোনও রাজ্য তো একসঙ্গে এত জনকে গ্রেফতার করতে পারেনি! আমরা আইন পাস করতে চেয়েছি। কেন্দ্র সেটাও করতে দিচ্ছে না।”
“টিএমসি মানে কী? তৃণমূল মডেল চিট!
তৃণমূল তো প্রতারণার মডেল
হয়ে গিয়েছে!”
অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি, কংগ্রেস মুখপাত্র
“ওঁদের পার্টির নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল
কংগ্রেস।মানুষ এখন বলছে ইন্ডিয়ান
ন্যাশনাল করাপশান পার্টি!”
অমিত মিত্র, রাজ্যের অর্থমন্ত্রী
মমতা একা নন, এ দিন তৃণমূল কংগ্রেস ভবন থেকেও সারদা কাণ্ড নিয়ে কংগ্রেসকে বিঁধেছেন অমিত মিত্র ও তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। সিবিআই নিয়ে মমতার সুরেই অমিতবাবু বলেন, “সিবিআইয়ের হাতে ২৩০০ মামলার কোনও কিনারা হয়নি। রাজ্যেরই ৪৫৮টি মামলা পড়ে আছে। নেতাই, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস, ছোট আঙারিয়া প্রভৃতি মামলার কোনও চূড়ান্ত ফয়সালা সিবিআই করতে পারেনি।” একই সঙ্গে তাঁর যুক্তি, “সারদা-কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন ও তাঁর দুই সহযোগীকে রাজ্য সরকারের পুলিশই কাশ্মীর থেকে গ্রেফতার করেছে।” পাশাপাশি দুর্নীতি-রোধে চিদম্বরমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অমিতের অভিযোগ, “হরিয়ানা-পঞ্জাবের একটি সংস্থা ৪৫ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে। প্রায় ৫ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চিদম্বরমের দফতরের পাশেই কনট প্লেসে এই সংস্থার হেড অফিস। কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে? কত জন টাকা ফেরত পেয়েছেন? কত জন গ্রেফতার হয়েছে?’’
সারদা-প্রশ্নে তৃণমূলকে কটাক্ষ করে সিঙ্ঘভি বলেছেন, “টিএমসি মানে কী? তৃণমূল মডেল চিট। তৃণমূল তো প্রতারণার মডেল হয়ে গিয়েছে!” যার জবাবে অমিত বলেন, “এ তো ভূতের মুখে রাম নাম! ওঁদের পার্টির নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস। আইএনসি। মানুষ এখন বলছে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল করাপশান পার্টি! এত দুর্নীতি এরা করেছে!”
তরজা সারদায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। একটি পুরনো অভিযোগের কথা পরোক্ষে খুঁচিয়ে সিঙ্ঘভিকে ব্যক্তিগত আক্রমণও করেছেন অমিতবাবু। তাঁর মন্তব্য, “২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল মনু সিঙ্ঘভি কেন সংসদের আইন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং দলের মুখপাত্রের পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy