Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

বাস ৯০০, পুরস্কার বাইক-স্কুটি, খয়রাতির নালিশ বিরোধীদের

অনুষ্ঠানে থাকবেন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী চার জেলার প্রায় ৩৪ হাজার প্রতিযোগী। তাঁদের আনতে বাস ‘বুক’ হয়েছে ৯০০-রও বেশি! রয়েছে মঞ্চ নির্মাণ-সহ আনুষঙ্গিক নানা খরচ। আর রয়েছে পুরস্কার। যার সংখ্যা ৫৮। মোটরবাইক ৫টি, স্কুটি ৫টি, মোবাইল ফোন ২টি, পেডেস্টাল ফ্যান ৯টি, মিউজিক সিস্টেম ৭টি, সাইকেল ২২টি এবং ৮টি ট্রফি। উপলক্ষ: জঙ্গলমহল কাপের পুরস্কার বিতরণ। স্থান: মেদিনীপুরের কলেজ মাঠ।

মেদিনীপুর কলেজ মাঠে মুখ্যমন্ত্রীর সভার প্রস্তুতি। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

মেদিনীপুর কলেজ মাঠে মুখ্যমন্ত্রীর সভার প্রস্তুতি। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

বরুণ দে
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৩
Share: Save:

অনুষ্ঠানে থাকবেন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী চার জেলার প্রায় ৩৪ হাজার প্রতিযোগী। তাঁদের আনতে বাস ‘বুক’ হয়েছে ৯০০-রও বেশি! রয়েছে মঞ্চ নির্মাণ-সহ আনুষঙ্গিক নানা খরচ। আর রয়েছে পুরস্কার। যার সংখ্যা ৫৮। মোটরবাইক ৫টি, স্কুটি ৫টি, মোবাইল ফোন ২টি, পেডেস্টাল ফ্যান ৯টি, মিউজিক সিস্টেম ৭টি, সাইকেল ২২টি এবং ৮টি ট্রফি।

উপলক্ষ: জঙ্গলমহল কাপের পুরস্কার বিতরণ। স্থান: মেদিনীপুরের কলেজ মাঠ। আজ, সোমবার পুলিশের উদ্যোগে আয়োজিত সেই জঙ্গলমহল কাপের প্রতিযোগীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে। রবিবার সন্ধে সাতটা নাগাদ মেদিনীপুর পৌঁছেও গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুরস্কার এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন মিলিয়ে খরচ প্রায় কোটি টাকা ছুঁয়েছে।

স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধীদের কটাক্ষ, রাজ্যের কোষাগারের ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ হাল! কিন্তু, মা-মাটি-মানুষের সরকারের দান-খয়রাতিতে কোনও কমতি নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী হামেশাই দাবি করেন, রাজ্যের কোষাগারের অবস্থা শোচনীয়। কেন্দ্র টাকা কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে! তাই তিনি চেয়েও পর্যাপ্ত উন্নয়ন করতে পারছেন না। এ সব সত্ত্বেও কেন বিপুল ব্যয়ে এই অনুষ্ঠান, প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য: ক্ষমতায় আসা ইস্তক উৎসব-প্রতিযোগিতায় মনোনিবেশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সরকার যে মা-মাটি-মানুষের, তা বোঝাতে সরকারের দান-খয়রাতির বহরও বেড়েছে বছর বছর। ১২০ কোটি টাকারও বেশি খরচ করে ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া হচ্ছে।

বিরোধীদের আরও দাবি, সম্প্রতি সারদা কেলেঙ্কারি, খাগরাগড় বিস্ফোরণ-সহ নানা ঘটনায় রাজ্য সরকার বেশ বেকায়দায়। সারদা-কাণ্ডে তৃণমূলের সাংসদ, মন্ত্রী পর্যন্ত জেলে গিয়েছেন। তার উপরে রাজ্যে বিজেপির উত্থান শাসকদলের মাথ্যাব্যথা আরও বাড়িয়েছে। আর তার ফলেই ভোটব্যাঙ্ক বজায় রাখতে ক্রমেই বাড়ছে খয়রাতির বহর, কটাক্ষ বিরোধীদের।

সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক দীপক সরকার বলেন, “এই সরকার বরাবরই দান-খয়রাতিতে অকৃপণ! সিভিক পুলিশেরা মাইনে পাচ্ছে না। অথচ উৎসব-আনন্দে যথেচ্ছ টাকা খরচ চলছেই। নানা ঘটনায় চাপে পড়ে খয়রাতির পরিমাণ আরও বাড়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।” বিজেপির জেলা সভাপতি তুষার মুখোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, “উৎসব আর মেলা করে সরকারি অর্থের অপচয়ই করা হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করলে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘উৎসব করব না তো কী শ্রাদ্ধ করব’!” জেলা তৃণমূল সভাপতি দীনেন রায় অবশ্য বলেন, “এই প্রতিযোগিতা জঙ্গলমহলের সামাজিক উন্নয়নেরই অঙ্গ। জঙ্গলমহল কাপ যে ব্যাপক আকারে হয়েছে, তাতে এই খরচটুকু সরকার করতেই পারে।” তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করিয়ে দিচ্ছেন, জঙ্গলমহলে শান্তি বজায় রাখতেই সরকারকে এমন জনসংযোগমূলক অনুষ্ঠান করতে হয়।

২০১২ সাল থেকে পুলিশের উদ্যোগে জঙ্গলমহল কাপ হয়ে আসছে। গত বছর মেদিনীপুরে ‘জঙ্গলমহল বিবেক ছাত্র-যুব উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে অবশ্য জঙ্গলমহল কাপের পুরস্কার বিতরণের জন্য আলাদা কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। ছাত্র-যুব উৎসবের মঞ্চ থেকেই জঙ্গলমহল কাপের পুরস্কার তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তা হলে কেন এ বার আলাদা ভাবে শুধু জঙ্গলমহল কাপের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল? খরচই বা কত? উত্তর পেতে জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষকে ফোন করা হলেও সাড়া মেলেনি।

জঙ্গলমহল কাপে মূলত ফুটবল, কবাডি ও তিরন্দাজি প্রতিযোগিতা হয়েছে। পুরুলিয়া জেলায় ছৌ নাচের প্রতিযোগিতাও ছিল। জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে মোট ৩৩,৯৪৯ জন প্রতিযোগী আসবেন। এ জন্য ৯২০টি বাস ‘বুক’ করা হয়েছে (একটি বাসে গড়ে ৪০ জন বসতে পারেন)।

তবে শুধু বাস বা পুরস্কার বাবদ খরচই নয়, প্রায় দু’মাস ধরে পাঁচটি জেলায় জঙ্গলমহল কাপ চালাতে গিয়েও সরকারের খরচ হয়েছে প্রচুর টাকা। শুধু পশ্চিম মেদিনীপুরেই ৩০৯টি দল ফুটবল খেলেছে। কাপে যোগদানকারী প্রতিটি দলের সকলকে জার্সি দেওয়া হয়েছে। খেলার সরঞ্জাম কেনা-সহ আয়োজনেও বিপুল ব্যয় হয়েছে। এক-একটি দল পিছু প্রায় ২৫ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে সরকারি সূত্রেরই খবর। বিরোধীদের প্রশ্ন, এই বিপুল আয়োজন করে লাভের লাভ কী হয়েছে? বরং ওই টাকা জঙ্গলমহলের গ্রামের উন্নয়নে কাজে লাগানো যেত। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার অবশ্য দাবি, “এমন কর্মসূচি জঙ্গলমহলের শান্তির পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করে। পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনীকেও তো বছরভর নানা জনসংযোগমূলক কর্মসূচি নিতে হয়।”

মুখ্যমন্ত্রী মেদিনীপুরে কবে আসবেন, তা নিয়ে সম্প্রতি বিস্তর জলঘোলা হয়েছে। প্রথমে ঠিক ছিল ২৪ নভেম্বর মেদিনীপুরে তৃণমূলের কর্মিসভায় উপস্থিত থাকবেন তিনি। পরে খড়্গপুরে পুরভোটের কথা মাথায় রেখে ১৯ ডিসেম্বর কর্মিসভা রেলশহরে করার সিদ্ধান্ত নেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু, খড়্গপুরের বিএনআর ময়দানে দলীয় সভার অনুমতি দেয়নি রেল। পরে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব জানান সভা হবে এক দিন পর, ২০ ডিসেম্বর। কিন্তু, মমতা দিল্লি সফরে ব্যস্ত থাকায় সভা ফের দশ দিন পিছিয়ে যায়। কেন বারবার দিন পাল্টাচ্ছে, এমন প্রশ্ন উঠে দলের অন্দরেই।

তৃণমূল সূত্রে অবশ্য জানান যাচ্ছে, দলনেত্রী আসলে মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল কাপের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, খড়্গপুরের কর্মিসভা এবং ঝাড়গ্রামের জঙ্গলমহল উৎসব এই তিনটি অনুষ্ঠানেই থাকতে চেয়েছিলেন। সে জন্যই ঝাড়গ্রামের জঙ্গলমহল উৎসবের সূচিও বদলে যায়। প্রথমে ঠিক ছিল উৎসব হবে ২৬-২৮ ডিসেম্বর। পরে ঠিক হয় ২৯-৩১ ডিসেম্বর ওই অনুষ্ঠান হবে। দলনেত্রীর ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতেই এই সূচি বদল, একান্তে কবুল করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। আজ, মঙ্গলবার খড়্গপুরে কর্মিসভাও করার কথা তৃণমূল নেত্রীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE