Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘ফোন নম্বর দে, নইলে দু’টোকেই শেষ করে দেব’

লাভপুরে নিহত সিপিএম সমর্থক তিন ভাইয়ের পরিবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের নাম নেয়নি। পুলিশও চার্জশিট থেকে বিধায়কের নাম বাদ দিয়েছে। পরিবারটি দাবি, ২০১১ সালে মনিরুলের অনুগামীরা নিহত এক ভাইয়ের ছেলে এবং অন্য ভাইয়ের মেয়েকে অপহরণ করেছিল। তাদের প্রাণ বাঁচাতেই জবানবন্দিতে কেউ মনিরুলের নাম নিতে পারেননি। অপহৃত টুম্পা খাতুন আনন্দবাজারকে সে দিনের অভিজ্ঞতার কথা শোনাল।তিন বছর আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে শিউরে উঠি। আমি তখন লাভপুরের আভাডাঙা গোপেশচন্দ্র হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। আর খুড়তুতো ভাই নেবলু (নিহত কোটন শেখের ছেলে) পড়ত নবগ্রাম প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। রোজের মতো সে দিনও লাভপুরের ভাড়াবাড়ি থেকে আমরা দুই ভাইবোন সাত কিলোমিটার দূরের ওই স্কুলে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য সে দিন টিফিনেই ছুটি নিয়ে নিই।

টুম্পা খাতুন। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

টুম্পা খাতুন। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০৩:৫৪
Share: Save:

তিন বছর আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে শিউরে উঠি। আমি তখন লাভপুরের আভাডাঙা গোপেশচন্দ্র হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। আর খুড়তুতো ভাই নেবলু (নিহত কোটন শেখের ছেলে) পড়ত নবগ্রাম প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। রোজের মতো সে দিনও লাভপুরের ভাড়াবাড়ি থেকে আমরা দুই ভাইবোন সাত কিলোমিটার দূরের ওই স্কুলে গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য সে দিন টিফিনেই ছুটি নিয়ে নিই।

পাশের স্কুল থেকে ভাইকেও ডেকে নিয়ে বাস ধরার জন্য শাওড়াগোড় বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ তিন জন আমাদের ঘিরে ধরে। মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলে, ‘চুপচাপ আমাদের সঙ্গে চলে আয়’। আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে যাই। বাসস্ট্যান্ডের কেউ টুঁ শব্দও পর্যন্ত করেনি। ওরা আমাদের হাঁটিয়ে গুনুটিয়ার দিকে নিয়ে গিয়ে একটা পরিত্যক্ত ঘরে আটকে রাখে।

অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটার সমস্ত জানলা-দরজাই ছিল বন্ধ। লোকগুলো আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছে। তা দেখে নেবলু ভয়ে কেঁদে ওঠে। লোকগুলোর শাসানিতে ও কান্না থামালেও ভেতরে ভেতরে ফুঁপিয়ে যাচ্ছিল।

লোকগুলো এ বার আমার কাছে বাবার ফোন নম্বর চাইল। আমি ওদের বলি, নম্বর আমার মনে নেই। তাতে খেপে গিয়ে ওরা সোজা আমার আর ভাইয়ের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘ফোন নম্বর দে, নইলে দুটোকেই শেষ করে দেব’।

আমি তখন ভয়ে বাবার ফোন নম্বরটা ওদের বলে দিই। ওরা সেই নম্বরে ফোন করে বাবাকে (সানোয়ার শেখ) হুমকি দিয়ে বলে, ‘তোর মেয়ে, ভাইপো আমাদের জিম্মায়। কোর্টে মনিরুলকে নির্দোষ বলে জবানবন্দি দিবি, না হলে এই দু’টোকে জবাই করে দেব’!

ভাই ফের কেঁদে উঠল। ওরা তখন আমাকে ফোনটা দিয়ে বলে, ‘বাবাকে বল, আমরা যা বললাম, তা-ই যেন করে’। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে সেটাই বলি। এর পরেই লোকগুলো দরজা বন্ধ করে বাইরে গিয়ে বসে।

এ ভাবে কতক্ষণ কেটেছিল, জানি না। এক সময় ওদের মোবাইলে একটা ফোন আসার আওয়াজ পেলাম। কিছু ক্ষণ পরে কানে এল ‘কাজ হয়ে গিয়েছে। দু’টোকে এ বার বাসস্ট্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে আয়’।

এক জন মোটরবাইকে চাপিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরে বুঝলাম দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। লোকটা আমাদের বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল। আমরা বাস ধরে লাভপুরের বাড়িতে ফিরলাম।

নেবলু এখন অন্য জায়গায় থাকে। কিন্তু, ভাইকে নিয়ে সে দিনের কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতা আজও মনে স্পষ্ট। সিনেমায় বহুবার বদমায়েশ লোকেদের বাচ্চা কিডন্যাপ করতে দেখেছি। কাগজেও অনেক খবর পড়েছি। কিন্তু আমাকে যে কোনও দিন অপহরণকারীদের খপ্পরে পড়তে হবে, তা জন্মেও ভাবিনি। অন্য ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে অপহৃতরা মুক্তি পায়। আমাদের মুক্তিপণ ছিল, বাপ-কাকাদের জবানবন্দি!

আমি এখন ক্লাস এইটে পড়ি। একাই ওই স্কুলে যাই। জানি না, আবার কোনও দিন ওই ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে কি না। কিন্তু, মনেপ্রাণে চাই ও রকম অবস্থায় যেন আর কাউকে পড়তে না হয়!

অনুলিখন: অর্ঘ্য ঘোষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE