সৌগত রায়কে অভিনন্দন ব্রাত্য বসুর।
তিন বছর আগের বিধানসভা ভোটের মতোই এ বার লোকসভা ভোটেও বাংলা জুড়ে ফুটল জোড়া ফুল! বাংলার রায় বুঝিয়ে দিল, এ রাজ্য এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে। গোটা দেশে যখন নরেন্দ্র মোদীর নামে ঝড়, এ রাজ্যে তখন ৪২টির মধ্যে ৩৪টি লোকসভা আসনই জিতল তৃণমূল।
বাকি দেশের প্রবণতার সঙ্গে তাল রেখে মোদী-হাওয়া এ রাজ্যেও প্রবেশ করেছে অবশ্যই। দার্জিলিঙের বাইরে আরও একটি আসন, আসানসোল জিতেছে বিজেপি। তাদের ভোটের হার বেড়ে হয়েছে ১৭%। যা এখনও পর্যন্ত তাদের সর্বাধিক ভোট। তবে তাদের এই উত্থান তৃণমূলকে বিশেষ স্পর্শ করেনি। শাসক দল পেয়েছে ৩৯.১% ভোট। গত বার নিজেদের ১৯-এর সঙ্গে কংগ্রেস এবং এসইউসি-র জোট ধরে যে ২৬ আসন ছিল, তার চেয়েও আসনসংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছে তৃণমূল! বিজেপি-র ঝড়ে বরং কুপোকাৎ হয়েছে বামেরা! পক্ষান্তরে, সংখ্যালঘু ভোটের বেশির ভাগই তৃণমূলের সঙ্গে থেকেছে বলে ভোটের ধরনে ইঙ্গিত মিলছে।
সারদা থেকে টেট কেলেঙ্কারি, ভোটের আগে শাসক দলকে জড়িয়ে পরপর দুর্নীতির অভিযোগ ভোটে যে তেমন আঁচড় কাটতে পারেনি, ফল থেকেই তা স্পষ্ট। আম রাজ্যবাসীর তৃণমূলে আস্থা এখনও মোটের উপরে অটুট। মোদীর সঙ্গে তরজার পরে সংখ্যালঘু ভোটকে আরও সংহত করে তাই রাজ্য রাজনীতিতে নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করতে পেরেছেন মমতা। জয়ের পরে তৃণমূল নেত্রীর প্রতিক্রিয়া, “এত কুৎসা, অপপ্রচার ডিঙিয়ে মানুষ যে রায় দিয়েছেন, তাতে আমি অভিভূত!” তিনি এ-ও বুঝিয়েছেন যে, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কেন্দ্রে সরকার গড়ে ফেললেও জনবিরোধী কোনও পদক্ষেপ হচ্ছে মনে করলে তৃণমূল তার ৩৪ সাংসদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করবে।
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
সেই ১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকে ধরলে এ বারই রাজ্যে বামেদের ফল সব চেয়ে শোচনীয়! শুধু রায়গঞ্জ এবং মুর্শিদাবাদ আসন দু’টি জিততে পেরেছে সিপিএম। গত লোকসভা ভোটে কলকাতার কাছাকাছি বামেদের আসন ছিল আরামবাগ। এ বার কলকাতার নিকটতম আসন বলতে মুর্শিদাবাদ! এবং আসন হারানোর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, ভোট প্রাপ্তির নিরিখে গত বেশ কয়েকটি নির্বাচনের মতো এ বারও বামেদের রক্তক্ষরণ থামার লক্ষণ নেই। গত বিধানসভা ভোটে বামেরা যেখানে ৪১% ভোট পেয়েছিল, সেখানে এই লোকসভায় সেই ভোট কমে দাঁড়িয়েছে ২৯.৭%-এ! গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে বামেরা গড়ে ভোট পেয়েছিল প্রায় ৩৭%। সেই ভোট ধরে রাখার আশা করেছিলেন বাম নেতৃত্ব। কিন্তু এ দিন ভোটযন্ত্র খুলতে দেখা গিয়েছে, কোনও ওষুধেই বাম রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না!
যদিও পঞ্চায়েত ভোটের সঙ্গে রাজনৈতিক গুরুত্বের বিচারে লোকসভার তুলনাই চলে না, তবুও দেখা যাচ্ছে ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূল পঞ্চায়েত ভোটে যে দাপট বাড়াতে পেরেছিল, এখনও তা অব্যাহত। লোকসভায় ৩৪টি আসন জিতে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম দল হয়ে ওঠার সঙ্গেই বিধানসভা উপনির্বাচনে ৬টির মধ্যে পাঁচটি আসনই দখলে নিয়েছে মমতার দল! আর ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে বামেরা। কেবল কিছু আসন হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়াই নয়, এই বিপর্যয়কে বামেদের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে-পড়া ভাবনাচিন্তার পরাজয় হিসাবেই দেখা হচ্ছে। তথাকথিত বাম ঘাঁটি বলে কিছুই যে আর রাজ্যে অবশিষ্ট নেই, এ বার জলপাইগুড়ির মতো লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের জয় থেকেই তার ইঙ্গিত পরিষ্কার।
তুলনামূলক বিচারে বামেদের চেয়ে অবশ্য কংগ্রেসের ফল ভাল। সোজাসাপ্টা হিসেবে, গত বারের ৬টি থেকে দু’টি আসন খুইয়েছে তারা। হেরেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি এবং মুর্শিদাবাদের সাংসদ মান্নান হোসেন। তবু দেশ জুড়ে প্রবল কংগ্রেস-বিরোধী ঝড়ের মুখে মালদহ ও মুর্শিদাবাদে নিজেদের গড় অনেকটাই সামলাতে পেরেছে অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন প্রদেশ কংগ্রেস। স্বয়ং অধীর জিতেছেন সাড়ে তিন লক্ষের বেশি ভোটে! এক দিকে তৃণমূল এবং অন্য দিকে মোদী-হাওয়ায় বলীয়ান বিজেপি এই দুই শক্তির মোকাবিলা করে কংগ্রেস নিজেদের এলাকায় সম্মানরক্ষা করতে পেরেছে, বলতেই হবে। রাজ্যে তাদের ভোট এ বার ৯.৬%। জঙ্গিপুরে ২০১২ সালের উপনির্বাচনে তৃণমূলের অনুপস্থিতিতে মাত্র আড়াই হাজার ভোটে জিতেছিলেন রাষ্ট্রপতি-পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। এ বার তৃণমূল, বিজেপি এবং বামেদের টপকে তাঁর জয় ৮ হাজার ভোটে। আবার দেবের মতো তারকার বিরুদ্ধে অনেক পরে ময়দানে নেমে ঘাটালে ১ লক্ষ ২২ হাজার ভোট পেয়েছেন মানস ভুঁইয়া। এ সবই আগামী বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের উৎসাহ বাড়াবে।
এখন প্রশ্ন, মোদী-ঝড়ে বামেরা ধরাশায়ী হল, দুই জেলার বাইরে কংগ্রেসের ঘরেও কিছুটা ধাক্কা লাগল অথচ তৃণমূলের ঘর অক্ষত থাকল এমন ঘটনা কী ভাবে সম্ভব হল? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এর অন্যতম কারণ সংখ্যালঘুদের কৌশলগত অবস্থান। রাজ্যে মোট সংখ্যালঘু ভোট এখন প্রায় ২৯%। ভোটের ধরন দেখে পর্যবেক্ষকেরা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, যেখানে যাদের সঙ্গে থাকলে নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত মনে হয়, সেখানে তাদেরই সমর্থন করেছেন সংখ্যালঘুরা। মালদহ, মুর্শিদাবাদে ওই ভোট যেমন কংগ্রেস পেয়েছে, দক্ষিণবঙ্গে তার সিংহভাগই গিয়েছে মমতার ঝুলিতে। তাই অধীরও বলেছেন, “সংখ্যালঘুরা সব সময় হিসেব করে ভোট দেন, তা হয়তো নয়। এ বার বিজেপি-র বিরুদ্ধে তাঁরা যেখানে যাকে বিশ্বস্ত মনে করেছেন, তাঁকেই ভোট দিয়েছেন।”
উঠে আসছে আরও একটি ব্যাখ্যা। মোদীই সুবিধা করে দিয়েছেন দিদির! প্রচারের শেষ দিকে মমতা-মোদীর পরস্পরকে আক্রমণ দু’জনকেই ফায়দা এনে দিয়েছে। মোদীর মোকাবিলায় সংখ্যালঘুরা ভরসা রেখেছেন মূলত শাসক দলের উপরে। ভোটের আগে ফুরফুরা শরিফের পীরদের উপরে আক্রমণ এবং তার জেরে তাঁদের বিবৃতি সত্ত্বেও। যে কারণে তৃণমূলের ভোটের হার বিশেষ এ দিক-ও দিক হয়নি। মোদীর পক্ষে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ হয়েছে, যার মাসুল দিয়েছে মূলত বামেরা। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি বা শ্যামল চক্রবর্তীর মতো নেতাদের প্রাথমিক ব্যাখ্যাও তা-ই।
শেষ মুহূর্তে প্রদেশ সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে অনেকটাই
বাঁচালেন রাজ্যের দুর্গ। শুক্রবার দলীয় অফিসে অধীর চৌধুরী।
সেই সঙ্গেই কংগ্রেসের এক নেতার মন্তব্য, “শরীর দুর্বল হলে নিউমোনিয়ার মতো রোগ হানা দেয়। সিপিএমের তা-ই হয়েছে। তৃণমূল এখন অনেক শক্ত-সমর্থ বলে মোদীর হানা তারা প্রতিরোধ করতে পেরেছে!” ঘটনাচক্রে, সংখ্যালঘু ভোট মূলত তৃণমূলের বাক্স থেকে নিজেদের দিকে আনতে সফল না-হলেও বামেদের এই দুর্দিনে তাদের দুই জয়ী প্রার্থীই কিন্তু সংখ্যালঘু! পোড়-খাওয়া মহম্মদ সেলিম ও নবাগত বদরুদ্দোজ্জা খান।
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের ব্যাখ্যা, তৃণমূল-বিরোধী ভোট এ বার তিনটি দলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। তার সুবিধা শাসক দল পেয়েছে। পাশাপাশি বামেদের মতো তাঁরও অভিযোগ, ভোট লুঠের বহু ঘটনা ঘটেছে। যদিও তাতে জনাদেশের বৃহত্তর ছবিতে বিশেষ হেরফের ঘটে না। অভিযোগ যা-ই করুক, ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে বিজেপি যথেষ্ট উজ্জীবিত। ঠিক উল্টো ছবি আলিমুদ্দিনে। তিন বছর আগে বিধানসভা ভোটে রাজ্যপাট হারানোর সময়েও এতটা বিষাদগ্রস্ত দেখায়নি আলিমুদ্দিনকে, যতটা এ দিন দেখিয়েছে! বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু মেনেই নিয়েছেন, “এই ফল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত!” বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো শীর্ষ নেতারা এক দিকে কবুল করছেন, কেন এত গভীর বিপর্যয় হল তাঁরা বুঝতে পারছেন না। অন্য দিকে ফল ঘোষণার পরে বাম শিবিরে দোষারোপও শুরু হয়েছে।
দু’টি আসন হারিয়েও বামেদের চেয়ে কিঞ্চিৎ স্বস্তিতে আছে প্রদেশ কংগ্রেস। প্রদেশ সভাপতি অধীরের কথায়, “খাদের মুখ থেকে শুরু করে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। সারা দেশের প্রেক্ষিতে রাজ্যের ফল সন্তোষজনক।”
শুক্রবার শৌভিক দে, দীপঙ্কর মজুমদার, সুদীপ্ত ভৌমিক ও বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy