ঘটনাস্থল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। জেলায় জেলায় কর্মী-সমর্থকদের আক্রান্ত হওয়ার খবর নিয়ে আসছে একের পর এক ফোন। ফেসবুক, টুইটার-সহ সোস্যাল মিডিয়া এবং আরও নানা মাধ্যমে অনবরত চলছে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিষোদগার। বেনজির এই পরিস্থিতিতে পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কথাই মাথায় এসেছিল বিমান বসুর। পদত্যাগপত্র এ বার লিখেও ফেলা হয়ে গিয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদককে দলের সহকর্মীরা তাঁকে ঠেকিয়ে রেখেছেন।
ঘটনাস্থল হেমন্ত বসু ভবন। দলের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের মুখোমুখি হয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ, বিধায়ক অক্ষয় ঠাকুর, সদ্যপ্রাক্তন সাংসদ নৃপেন রায়েরা। তাঁদের বক্তব্য, ভোটের আগে থেকেই কোচবিহারে বাম কর্মী-সমর্থকদের উপরে আক্রমণ চলছিল। লোকসভা ভোটের প্রথম পর্বের দিন কোচবিহারে ঝামেলা হল, জেলার নেতারা ধর্নায় বসলেন। কমিশনের উপরে ভরসা রেখে দুপুরের পরে অবস্থান তুলে নিতে বলা হল। অথচ দুই পর্বের ভোট মিটে যেতে রাজ্য বামফ্রন্ট নেতৃত্ব বুঝতে পারলেন, কমিশনের উপরে আস্থা রেখে লাভ নেই। প্রথমেই কেন তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন না? কেন কোচবিহারে গিয়ে দাঁড়ালেন না রাজ্য নেতাদের কেউ?
অবিশ্রান্ত আক্রমণের মুখে বিমানবাবুর মতোই এখন অসহায় অশোকবাবু! এক দিকে পদত্যাগের দাবিতে শোরগোল। আবার তারই মধ্যে রাজ্যের নানা প্রান্তে ভোট-পরবর্তী হিংসায় আক্রান্ত হচ্ছেন কর্মী-সমর্থকেরা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শীর্ষ নেতাদের কেউ আক্রান্তদের ভরসা দিতে যেতে পারছেন না। স্রেফ পিঠ বাঁচাতে নিচু তলার অনেকে ভাবছেন বিজেপি-তে নাম লেখানোর কথা। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়ে গেলে যদি মার একটু কমে!
সিপিএমের নেতাদের উপরে চাপ বাড়িয়েছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। দল থেকে বহিষ্কৃত এই নেতা বুধবার বলেন, জ্যোতি বসু যে ভাবে নিরন্তর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে বলতেন, সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন এখনকার নেতারা। মানুষ এবং দলের কর্মী, কারও সঙ্গেই তাঁদের আত্মিক যোগাযোগ নেই। সাম্প্রতিক কালে কোনও জ্বলন্ত বিষয়ে তেমন আন্দোলন গড়তেও তাঁরা ব্যর্থ। সোমনাথবাবুর কথায়, “বর্তমান নেতৃত্ব বহু দিন পদে রয়েছেন। এ বার নতুন নেতৃত্ব এসে মানুষকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করুন।” প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতার বক্তব্য, দলে ভাল কাজ করার মতো তরুণ-তরুণীদের অভাব নেই। তাঁদের তুলে আনতে হবে।
পরিস্থিতি আঁচ করেই বিমানবাবু এ বার মানসিক ভাবে ঠিক করে ফেলেছেন, আর নয়। দলের কর্মী-সমর্থকেরাই যখন পদত্যাগের দাবিতে এমন উতলা, তা হলে পদ আঁকড়ে না থাকাই ভাল। ছাত্র জীবনে বাড়ি ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লিখিয়েছিলেন। এখন থাকেন দলীয় কার্যালয়েই। রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব তাঁর কাছে ‘লাভজনক পদ’ নয়। কর্মীরা যদি মনে করেন নেতা পরিবর্তন করলেই সব ঠিক হবে, তা-ই হোক! কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্ব তাঁকে বোঝাচ্ছেন, এ বার লোকসভা ভোটে নতুন কৌশলে লড়াইয়ের চেষ্টা হয়েছিল। বহু নতুন মুখ আনা হয়েছে প্রার্থী তালিকায়, আলাদা বিষয় ধরে ছোট পুস্তিকা করা হয়েছে, পরিকল্পনা করে প্রচার বেঁধে রাখা হয়েছে নিচু তারে। ঘটনা যে, এর পরেও ফল খারাপ হয়েছে। কিন্তু এর জন্য বিমানবাবু ইস্তফা দিলে গোটা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীকেই তা-ই করতে হয়!
দলের অন্দরে বিমানবাবুর প্রশ্ন, নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করে তিনি না হয় আপাতত রয়ে গেলেন। কিন্তু কিছু দিন পরেই ১৭টি পুরসভার ভোটে লড়াইয়ের রসদ না পেয়ে আবার যে-ই ব্যর্থতা আসবে, আবার তো মুণ্ডপাত হবে! আলিমুদ্দিনে এ দিন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী দিনভর আপৎকালীন ব্যবস্থা নিয়েই আলোচনা চালিয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে মধ্যবর্তী এই কৌশলই ভাবা হচ্ছে যে, আসন্ন সম্মেলনের প্রক্রিয়া কয়েক মাস এগিয়ে এনে নেতৃত্বে যা রদবদল করার, তখনই করা হোক। তবে দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “জুনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের আগে কিছুই বলা যাবে না।”
আপাতত বাম শিবিরেই দাবি উঠেছে, জেলায় জেলায় হামলার প্রতিবাদে রাজ্য থেকে বামেদের পাঁচ সাংসদ ও বিধায়কেরা ধর্নায় বসুন। সঙ্গে জারি আছে ফেসবুক-বিপ্লব! দলের নেতা দেবরাজনের বক্তব্যের সূত্রে ফব-র উদয়নবাবু যেমন পোস্ট করেছেন, ‘যাঁরা এই বয়সে ঠিকমতো মলমূত্র ত্যাগ করতে পারেন না, তাঁরা আর যা-ই হোক পদত্যাগ করবেন না’! ফব-রই যুব নেতা অনির্বাণ চৌধুরীর মন্তব্য, ‘এক সময় বলা হয়েছিল নেতা নয়, নীতির বদল চাই। এখন আওয়াজ তোলা দরকার, নীতি ঠিক আছে। নেতার বদল চাই’! আলিমুদ্দিনে একটা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী বা দিল্লিতে একটা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক যে এই সঙ্কটের মীমাংসা করতে পারবে না, বলাই বাহুল্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy