Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

শাকিলের দোকানে এখনও সেই সাইনবোর্ড

বন্ধ দোকানটার সামনে সোমবার রাতেও চুমকি বসানো দুটো বোরখা ঝোলানো রয়েছে। বেলডাঙার বড়ুয়া মোড় থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ছেড়ে বাঁ দিকে নেমে যাওয়া রাস্তাটার মুখেই শিশু মাদ্রাসা বাজার। বাজারের দোতলায় রাস্তামুখী দোকান, ‘বোরখা ঘর’। রংহীন দেওয়ালে ততোধিক পুরনো ফ্লেক্সের উপরে বাংলা হরফে সে লেখাও ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে। নীচে প্রোপ্রাইটারের নাম, শাকিল আহমেদ। রয়েছে ফোন নম্বরও।

বেলডাঙায় শাকিলের বোরখার দোকান।  নিজস্ব চিত্র

বেলডাঙায় শাকিলের বোরখার দোকান। নিজস্ব চিত্র

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
বেলডাঙা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১১
Share: Save:

বন্ধ দোকানটার সামনে সোমবার রাতেও চুমকি বসানো দুটো বোরখা ঝোলানো রয়েছে।

বেলডাঙার বড়ুয়া মোড় থেকে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ছেড়ে বাঁ দিকে নেমে যাওয়া রাস্তাটার মুখেই শিশু মাদ্রাসা বাজার। বাজারের দোতলায় রাস্তামুখী দোকান, ‘বোরখা ঘর’।

রংহীন দেওয়ালে ততোধিক পুরনো ফ্লেক্সের উপরে বাংলা হরফে সে লেখাও ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে। নীচে প্রোপ্রাইটারের নাম, শাকিল আহমেদ। রয়েছে ফোন নম্বরও।

বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণে শাকিলের মৃত্যুর পর সে দোকানে এখন তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে পুলিশ। বাজারের মুখেও বসেছে পুলিশ প্রহরা। তবে ওইটুকুই।

ঘটনার পাঁচ দিন পরেও বোরখা ঘর বা খানিক দূরে ফরাজিপাড়ায় শাকিলের বোরখা তৈরির কারখানায় কর্মীদের কাউকেই খুঁজে পায়নি পুলিশ। টালির চালার নীচে পরপর পাঁচখানা ঘর নিয়ে সেই বোরখা তৈরির কারখানার দেওয়াল সদ্য উঁচু করা হয়েছে। সেখানেও ঝুলছে পুলিশি-তালা। পাড়ার লোকজন আড়চোখে সেই তালা দেখে থমকে দাঁড়ালে এগিয়ে আসছেন উর্দিধারীরা, ‘‘কী চাই?’’ পুলিশের অনর্গল প্রশ্নের মুখে ফরাজিপাড়ার বোরখা কারখানার আশপাশের ঘর-গৃহস্থালির বাসিন্দারাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

মুখ খুলছেন শুধু আমিনুল ইসলাম। টালির ওই পাঁচ-ঘরের মালিক। কাঁচুমাচু মুখে আমিনুল বলছেন, “শাকিলকে আমি কোনও দিনই দেখিনি। ঘর ভাড়া নিয়েছিল তার কর্মচারী মতিউর রহমান।” তাঁকে কী করে চিনলেন? আমিনুল বলেন, “পাড়ার মসজিদে নমাজ পড়তে যেতাম। সেখানেই মতিউরের সঙ্গে আরও চার-পাঁচ জন যুবক পাঁচ ওয়ক্তের নমাজ পড়তে আসত। বলেছিল কৃষ্ণনগরের রায়পুরে বাড়ি। তবে ওই যুবকদের মধ্যে শাকিল নামে তো কেউ ছিল না।” তিনি জানান, ওই যুবকেরা পাঁচ ওয়ক্তের নমাজ পড়া ছাড়াও মাথায় টুপি পরতো, লম্বা দাড়ি রাখত। আমিনুলের কথায়, “অবিশ্বাস করিনি, ভেবেছিলাম সাচ্চা মুসলমান। তিন হাজার টাকায় তাই ঘর ভাড়া দিয়েছিলাম।” তিনি অবশ্য কোনও পরিচয়পত্র, এমনকী ফোন নম্বরও নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি মতিউরের কাছ থেকে। স্থানীয় দেবকুণ্ডু পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য সামাদ আলি বলেন, “গ্রামে পরিচয়পত্রের কড়াকড়ি তেমন নেই। পাশের সিনিয়র মাদ্রাসায় অনেক ছেলেই আসে, বাইরে থেকে পরীক্ষা দিতে। তাদের মাঝে-মাঝেই ঘর ভাড়া দিতে হয়। পরিচয়পত্র সবাই তো দেখাতে পারে না।” তা ছাড়া আমিনুলের যুক্তি, “বড়ুয়া আহেলা হাদিসের ইমাম ফিরদৌস কারিও ওঁদের বিশ্বাস করেছিলেন। ফলে আমি আর প্রশ্ন তুলিনি।” ফিরদৌস কারিও জানান, নমাজ পড়ার সূত্রে ওই যুবকদের তিনি চিনতেন। তিনি বলেন, “সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না।”

কিন্তু ওই যুবকদের মধ্যে ইদ্রিশ কিংবা ইউসুফ নামে কেউ ছিল?

আমিনুল এ দুটো নামও মনে করতে পারেননি। তবে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বোরখা কারখানার কর্মী ওই দুই যুবকও পুলিশের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। বোরখা কারখানায় দিনভর ঘটাং ঘট শব্দ কিংবা সেলাই মেশিনের অনর্গল ঘড়ঘড় পড়শিরা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন। তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন জাগেনি বলেই জানিয়েছেন আশপাশের ফারুক শেখ থেকে রেহানা বিবিরা।

কারখানা থেকে বোরখা প্যাকেট বন্দি হয়ে চালান যেত শিশু মাদ্রাসা বাজারের বোরখা ঘরে। বাজার কমিটির কাছ থেকে শাকিল নিজের নামেই ওই ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে। প্রথমে এক তলায় একটি ঘর ভাড়া নেন শাকিল। পরে দোতলায় উঠে যায় তাঁর দোকান। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছিল শাহজামাল নামে এক যুবক। সে কে? পুলিশ তার পরিচয় স্পষ্ট করতে চায়নি। তবে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, ওই যুবকের মধ্যস্থতায় বাজার কমিটি শাকিলকে ঘর ভাড়া দিয়েছিল। সোমবার ঈদ উপলক্ষে বাজার বন্ধ থাকায় কমিটির কাউকে পাওয়া যায়নি।

তবে বাজারের থেকে ঢিল ছোড়া দূরে রাস্তার পাশেই পাওয়ার হাউস পাড়ায় শাকিলের ভাড়াবাড়ির মালিক ওলিউল ইসলাম বলেন, “স্ত্রী, একটি চার বছরের ছেলে এবং তিন ও এক বছরের দু’টি মেয়েকে নিয়ে থাকত শাকিল। তার স্ত্রী সব সময়েই বোরখা পড়ে থাকত। তবে প্রায়ই ওরা এক-দেড় মাসের জন্য উধাও হয়ে যেত।” ওলিউল জানান, বেশ রাত করে একটি এম-৮০ স্কুটারে বাড়ি ফিরতেন শাকিল। বাড়ির হাজার টাকা ভাড়া কখনও বাকি পড়েনি তাঁর। তিনি বলেন, “শাকিল বেশ ফর্সা ছিল। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফিট উচ্চতা। মাস দুয়েক আগে সপরিবার চলে গিয়েছিল ওরা।” তবে তা নিয়ে মাথা ঘামাননি ওলিউল। কারণ এমনটা আগেও ঘটেছে। তিনি বলছেন, “তখন কী জানতাম, তলে তলে এত কাণ্ড ঘটছে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE