Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সিটেই তুষ্ট ডিভিশন বেঞ্চ, সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছেন হৃদয়

পাড়ুই-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের যে নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ দিয়েছিল, বুধবার তা খারিজ করে দিল ডিভিশন বেঞ্চ। অর্থাৎ পাড়ুই কাণ্ডে ডিজি-র নেতৃত্বাধীন সিট-এর তদন্তই মান্যতা পেল রায়ে। সিট ইতিমধ্যেই বীরভূম আদালতে ওই মামলার চার্জশিট পেশ করেছে।

রায় শোনার পর বোলপুরের বাড়িতে অনুব্রত মণ্ডল।  ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

রায় শোনার পর বোলপুরের বাড়িতে অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

পাড়ুই-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের যে নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ দিয়েছিল, বুধবার তা খারিজ করে দিল ডিভিশন বেঞ্চ। অর্থাৎ পাড়ুই কাণ্ডে ডিজি-র নেতৃত্বাধীন সিট-এর তদন্তই মান্যতা পেল রায়ে। সিট ইতিমধ্যেই বীরভূম আদালতে ওই মামলার চার্জশিট পেশ করেছে। সেই চার্জশিটে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বা তাঁর কোনও অনুগামীর নাম নেই।

কেন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ খারিজ করা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যায় বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাস এবং বিচারপতি ঈশানচন্দ্র দাসের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, পাড়ুই-কাণ্ডের তদন্ত রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে এবং কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ছাতা দিয়ে আড়াল করা হয়েছে বলে বিচারপতি হরিশ টন্ডন তাঁর রায়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু কী কারণে বিচারপতি টন্ডন সেই পর্যবেক্ষণ করলেন, রায়ে সে কথা বলা হয়নি। সিটের তদন্ত রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ পাওয়ার কথাও বিচারপতি টন্ডনের রায়ে উল্লেখ করা হয়নি।

মামলার আবেদনকারী পাড়ুই-কাণ্ডে নিহত সাগর ঘোষের ছেলে হৃদয় ঘোষ ডিভিশন বেঞ্চের এই রায়ে হতাশ। তিনি বলেন, “আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাব। সুপ্রিম কোর্টে আমরা জেতার বিষয়ে আশাবাদী।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে সাগর ঘোষের পরিবার এবং সাধারণ মানুষ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছেন। তবে সাগর ঘোষের পরিবার সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। আইনের রাস্তা এখনও খোলা আছে।” হৃদয়বাবুর আইনজীবী শীর্ষেন্দু সিংহ রায়ের দাবি, “সুপ্রিম কোর্টে মামলার ফল অন্য রকম হবে।” রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মামলার প্রসঙ্গ তুলে ওই আইনজীবী বলেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঠিক করা সংক্রান্ত মামলায় গত বছর কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে হেরে গিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে তারা মামলা জিতে যায়।

তবে ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে রাজ্য সরকারের আইনজীবীরা খুশি। তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও বলেন, “রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করে আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। প্রথম থেকেই আমি বলে আসছি, তদন্তে কোনও প্রভাব খাটানো হচ্ছে না।”

এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের যে দু’টি মামলা চলছে সেই দু’টিতেই রাজ্য সরকার আবেদনকারী। প্রথমটি সিঙ্গুর মামলা, দ্বিতীয়টি প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানের আগাম জামিনের মামলা। ওই দুটি মামলাতেই কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য সরকারের বিপক্ষে রায় দিয়েছিল। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা মমলাতেও হার হয়েছে রাজ্যের। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই সিবিআই এখন সারদা-কাণ্ডের তদন্ত করছে। আগামী সপ্তাহেই এই তালিকায় যুক্ত হবে পাড়ুই মামলা।

ঠিক কী ঘটেছিল বীরভূমের পাড়ুইয়ে? গত বছরের ২১ জুলাই বীরভূমের পাড়ুই থানার কসবা গ্রামে গুলিবিদ্ধ হন নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ। দু’দিন পরে বর্ধমান হাসপাতালে মৃত্যু হয় সাগরবাবুর। ওই খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ওই ঘটনার কয়েক দিন আগেই বিরোধী ও পুলিশকে লক্ষ করে বোমা ছোড়ার কথা প্রকাশ্যে বলেন অনুব্রত। পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করছে না এই অভিযোগ তুলে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন সাগরবাবুর পরিবার।

পুলিশি তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত রাজ্য পুলিশের ডিজি-র নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গড়ে দেন। শিবানীদেবীর অভিযোগপত্রকেই এফআইআর ধরে সিটকে তদন্তের নির্দেশও দেন তিনি। পরবর্তী কালে মামলাটি চলে আসে বিচারপতি হরিশ টন্ডনের আদালতে। সিটের তদন্ত সন্তুষ্ট করতে পারেনি বিচারপতি টন্ডনকেও। তিনি তাঁর এজলাসে তলব করেন সিটের প্রধান ডিজিপি-কে। গত ৪ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে ডিজিপি জিএমপি রেড্ডি পাড়ুই মামলায় অনুব্রত মণ্ডলকে কার্যত ‘ক্লিনচিট’ দেন।

পাড়ুই মামলার তদন্ত ২৪ সেপ্টেম্বর সিবিআই-য়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হরিশ টন্ডন। তার দু’দিন পরে সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয় রাজ্য সরকার।

আর কী কী কারণে সিবিআই তদন্ত খারিজ করল ডিভিশন বেঞ্চ?

ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, সাগর ঘোষ খুনে ষড়যন্ত্রের দিকটি সিট তদন্ত করে দেখেনি বলে আদালতে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কিত যে পাঁচটি রিপোর্ট সিট আদালতে পেশ করেছে, তা থেকে এ’টি স্পষ্ট যে ষড়যন্ত্রের দিকটিও তদন্ত করা হয়েছে। বিচারপতি হরিশ টন্ডন তাঁর রায়ে খুনের ঘটনার আরও তদন্ত করতে বলেছেন। ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন জানায়, কেন ‘আরও তদন্ত’ করতে হবে অথবা খুনের ঘটনার কেন ‘পুনরায় তদন্ত’ হওয়া দরকার, তার কোনও কারণ উল্লেখ নেই বিচারপতি টন্ডনের রায়ে।

হাইকোর্টের নজরদারিতে সাগর ঘোষ খুনের তদন্ত করেছে সিট। সিট-এর প্রধান রাজ্য পুলিশের ডিজি তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে আদালত ছাড়াও রাজ্য সরকারকেও জানিয়ে ঠিক কাজ করেননি বলে ডিভিশন বেঞ্চে অভিযোগ করেছিলেন সাগরবাবুর পুত্রবধূ শিবানীর আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি। ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, তদন্তের অগ্রগতি সংক্রান্ত রিপোর্ট রাজ্য সরকারও জানতে পারায় তা পুনরায় তদন্তের অন্যতম কারণ হতে পারে না।

তৃণমূলের বীরভূম জেলার সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল পাড়ুই-কাণ্ডে গ্রেফতার না হওয়ায় তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আদালতে। ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন জানিয়ে দিয়েছে, অনুব্রত মণ্ডল গ্রেফতার হননি বলেই সিবিআইকে দিয়ে আরও তদন্ত করতে হবে, এই যুক্তি ঠিক নয়। ডিভিশন বেঞ্চ আরও জানিয়েছে, সিট পাড়ুই মামলার যে তদন্ত করেছে, বিচারপতি হরিশ টন্ডন সেই তদন্তকে খারিজ করে দেননি। এমনকী, সিট চলতি বছরের ১৮ জুলাই পাড়ুই মামলার যে চার্জশিট পেশ করে, সেই চার্জশিটও খারিজ করেননি বিচারপতি টন্ডন। সুতরাং তদন্ত হয়নি, এ কথাটা বলা যায় না।

নিহত সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দি দিতে চেয়েছিলেন। হৃদয়ের স্ত্রী শিবানী আইনজীবীর মাধ্যমে ডিভিশন বেঞ্চে অভিযোগ করেন, ওই জবানবন্দি তাঁর স্বামীকে দিতে দেওয়া হয়নি। ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন জানিয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দি দেওয়ানোর বিষয়টি একেবারেই তদন্তকারী অফিসারের বিচার্য বিষয়।

বিচারপতি টন্ডন তাঁর রায়ে জানান, খুনের তদন্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা গিয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, কীসের ভিত্তিতে বিচারপতি টন্ডন এই পর্যবেক্ষণ করেছেন, তা তাঁর রায়ে উল্লেখ করা হয়নি। এই ধরনের পর্যবেক্ষণ করার আগে আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলেও জানিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE