Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

সিভিল সার্ভিস পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজছে রাজ্য

আমূল সংস্কার এ বার রাজ্যের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতেও। মান্ধাতা আমল থেকে যে বিষয়গুলি পড়ে ডব্লিউবিসিএসে বসতেন এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরা, তার কিছু কাটছাঁট করে, কিছু সময়োপযোগী বিষয় ঢুকিয়ে ঢেলে সাজা হয়েছে ওই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নয়া পাঠ্যক্রম।

সুপ্রকাশ চক্রবর্তী ও দেবজিৎ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৪ ০৩:০১
Share: Save:

আমূল সংস্কার এ বার রাজ্যের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতেও।

মান্ধাতা আমল থেকে যে বিষয়গুলি পড়ে ডব্লিউবিসিএসে বসতেন এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরা, তার কিছু কাটছাঁট করে, কিছু সময়োপযোগী বিষয় ঢুকিয়ে ঢেলে সাজা হয়েছে ওই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নয়া পাঠ্যক্রম। এবং আগামী জুন মাসেই নতুন পাঠ্যসূচি মেনে রাজ্যের পরবর্তী সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা হবে বলে নবান্ন সূত্রের খবর।

কেন এই সংস্কার?

রাজ্যের কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের সচিব অজিতরঞ্জন বর্ধনের কথায়, “দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রায়ই নতুন নীতি প্রণয়ন হচ্ছে। প্রশাসন চালাতে সেগুলো জানা একান্ত জরুরি। কিন্তু ডব্লিউবিসিএসের পাঠ্যক্রমে সে সব তো নেই-ই, উল্টে এমন কিছু বিষয় পড়তে হচ্ছে, যার সঙ্গে প্রশাসনিক কাজের কোনও সম্পর্ক নেই।” মূলত সে দিকে তাকিয়েই ডব্লিউবিসিএসের নয়া পাঠ্যক্রমকে আরও কর্মমুখী করতে দীর্ঘ দিনের পরীক্ষা পদ্ধতিতে সংস্কার আনা হয়েছে বলে জানান ওই সচিব।

যেমন আগের পাঠ্যক্রমে পরিবেশ বিষয়ক কোনও অনুচ্ছেদই ছিল না। এ বার তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কেন? রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, যত দিন যাচ্ছে, পরিবেশের বিষয়টি সংবেদনশীল হয়ে উঠছে। এমনকী, দূষণের সংজ্ঞাটাও বদলে গিয়েছে। আগের মতো এখন খেয়ালখুশি মতো গাছ কাটা যায় না, জলাভূমিও ভরাট করা যায় না। ‘পরিবেশ বাঁচাও’-এর স্লোগান সামনে রেখে গোটা দেশে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তৈরি হয়েছে। শুধু গাছ কাটা বা জলাশয় ভরাটই নয়, কোনও কারখানা থেকে রাসায়নিক দূষণ ছড়ালে তারও প্রতিবাদ হচ্ছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকও নিত্যনতুন আইন প্রণয়ন করেছে। কিছু বিধিনিষেধও আরোপ করেছে। ভারী শিল্প তো বটেই, ছোট ও মাঝারি মানের প্রকল্প তৈরি করতে গেলেও এখন পরিবেশের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। এ রাজ্যে নয়াচর কিংবা ওড়িশার পস্কো তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। তাই ভবিষ্যতে যাঁরা প্রশাসকের ভূমিকা নেবেন, তাঁদের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনকানুন জানা একান্ত জরুরি বলেই মনে করছেন নবান্নের কর্তারা।

পরিবেশের পাশাপাশি যে বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিরোধ বাধছে, সেটি হল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় আঞ্চলিক দলগুলি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বেশ কিছু রাজ্যে শাসনের রাশও তাদের হাতে। সে কারণে নিজেদের দাবিদাওয়া, একই সঙ্গে আর্থিক বঞ্চনার অভিযোগ তুলে প্রায়ই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছে ওই সব রাজ্যের সরকার। তাই রাজ্যের সিভিল সার্ভিসের নয়া পাঠ্যক্রমে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ঢোকানোর পাশাপাশি কী ভাবে রাজ্যগুলি তাদের হকের কেন্দ্রীয় অনুদান পায়, সেই বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নবান্নের এক কর্তা বলেন, “আগে ভারতীয় সংবিধানের কিছু গতে বাঁধা অনুচ্ছেদ ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পড়লেই চলতো। কিন্তু এখন অর্থনীতির গণ্ডি অনেক বড় হয়েছে। সেখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটা বড় ভূমিকা আছে। এমনকী, রাজ্যগুলিকেও প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। তাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালন সম্পর্কিত কিছু অনুচ্ছেদ নয়া পাঠ্যসূচিতে রাখা হয়েছে।”

এ ভাবেই বর্তমান শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডব্লিউবিসিএসের পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এবং এই পাঠ্যক্রম কেবল রাজ্যের সিভিস সার্ভিসেই নয়, কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের (যে পরীক্ষায় পাশ করলে আইএএস-আইপিএস হয়) পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রেও যাতে এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরা কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকে, সেই বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছে সরকার।

কী ভাবে? রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, এত দিন ডব্লিউবিসিএসের প্রথম ধাপের পরীক্ষাতেই (প্রিলিমিনারি) কেবল ইতিহাস ও ভূগোল পড়তে হতো। এ বার মূল (মেন) পরীক্ষাতেও ওই দু’টি বিষয় ঢোকানো হয়েছে, যেমন আছে কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের পাঠ্যসূচিতে। ওই আমলার বক্তব্য, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের পাঠ্যক্রমে এত বেশি তফাত ছিল যে ডব্লিউবিসিএসে উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসতে হলে কেঁচে গণ্ডুষ করতে হতো। নয়া পাঠ্যসূচিতে সেই তফাতটাই কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার এই খোলনলচে বদলে আখেরে এ রাজ্যের ছেলেমেয়েরাই লাভবান হবে বলে মনে করছেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ক্যালকাটা-র ডিন (এনআইইআর) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর বক্তব্য, “বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নজরদারি চালানোই প্রশাসকদের এক মাত্র কাজ নয়। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে তারা সাহায্যকারীও (ফেসিলিটেটর) বটে।” অর্থাৎ, প্রশাসন চালানোর পাশাপাশি রাজ্যের উন্নয়নেও সামিল হতে হবে প্রশাসকদের। প্রকল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁদেরও অনুঘটকের ভূমিকা নিতে হবে।

পাঠ্যক্রমই শুধু নয়, ডব্লিউবিসিএসের প্রবেশিকা পরীক্ষা থেকে ফল প্রকাশের সময়কাল কমাতে গোটা পদ্ধতিতেই বদল এনেছে কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতর। এত দিন মূল বিভাগে ছ’টি পরীক্ষার উত্তরপত্র বিস্তারিত ভাবে লিখতে হত। ছিল দু’টি ঐচ্ছিক পত্র। নয়া পাঠ্যসূচিতে ঐচ্ছিক বিষয় দু’টি থেকে কমিয়ে একটি করা হয়েছে। পাশাপাশি মূল ছ’টি বিষয়ের মধ্যে চারটিরই পরীক্ষা হবে মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেনস বা এমসিকিউ পদ্ধতিতে। ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষা পরিচালনা করে যে সংস্থা, সেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান নুরুল হক বলেন, “সময় বাঁচাতে ব্যক্তিত্বের পরীক্ষা (পার্সোনালিটি টেস্ট) পদ্ধতিও বদলে ফেলা হয়েছে। এত দিন রাজ্য সিভিল সার্ভিসের এ, বি, সি, ডি এই চারটি গ্রুপে উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা পৃথক ভাবে পরীক্ষায় বসতেন। এ বার একই দিনে সকলের পরীক্ষা হবে এবং এখানেও কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের পথেই হেঁটেছে রাজ্য সরকার।

সরকারের এই নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ডব্লিউবিসিএস অফিসার সংগঠনও। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সৌরভ চাকী বলেন, “সমস্ত সর্বভারতীয় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এমসিকিউ ধাঁচে হচ্ছে। তার সঙ্গে তাল মেলাতে রাজ্যের সিভিল সার্ভিসেও বদল জরুরি ছিল। গন্ধমাদন পর্বত খুঁজে বিশল্যকরণী জোগাড় করতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠতেন ছেলেমেয়েরা।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE