কুণাল ঘোষ, শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য তো আছেনই। তালিকায় রয়েছে ‘প্রভাবশালী’ আরও একাধিক নাম। কেউ শাসকদলের ঘনিষ্ঠ, কারও আবার মাখামাখি ছিল সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে। এবং সকলেই নানা ভাবে সারদার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ। সারদা-কেলেঙ্কারির জেরে এ বার তাঁদের সকলের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নোটিস দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।
ইডি-সূত্রের খবর: ওই সব ব্যক্তি সারদার থেকে বিভিন্ন সময়ে অন্যায্য ভাবে যত টাকা নিয়েছেন, তা ফেরত দেওয়ার একটা সুযোগ দেওয়া হবে। ফেরাতে না-পারলে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিলামে তুলে টাকা উদ্ধার করা হবে। ইডি আপাতত সারদা গোষ্ঠীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কাজ চালাচ্ছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, প্রথম দু’দফায় দেড়শো কোটি টাকার বেশি সারদা-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এই পর্ব শেষ হলে তালিকার লোকজনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত সংক্রান্ত নোটিস পাঠানো শুরু হবে।
প্রশ্ন উঠছে, কুণাল ঘোষ বা মিঠুন চক্রবর্তীরা তো সারদার মিডিয়া সংস্থায় চাকরি করে কিংবা পরিষেবা দিয়ে তবেই টাকা নিয়েছেন! তা হলে সেই টাকা ওঁদের ফেরত দিতে হবে কেন? ফেরাতে না-পারলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তই বা করা হবে কেন?
ইডি-অফিসারদের যুক্তি, প্রথমত সারদার থেকে যে অর্থ ওঁরা নিয়েছেন, সারদা তা বাজার থেকে তুলেছিল জনগণকে ভুল বুঝিয়ে, প্রতারণা করে। “প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং আইনের তিন নম্বর ধারা অনুযায়ী, প্রতারণার মাধ্যমে বাজার থেকে তোলা টাকার সঙ্গে কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত থাকলে তিনিও দায় এড়াতে পারেন না।” বলছেন এক ইডি-অফিসার। তাঁর কথায়, “কে কী পরিষেবা দিয়েছেন, সেটা এখানে গৌণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ওঁদের পকেটে যাওয়া টাকা আমজনতাকে ঠকিয়ে আদায় হয়েছিল কি না।”
তা হলে যাঁরা সারদা সংস্থার বিভিন্ন শাখায় সাধারণ চাকরি করে বেতন নিতেন, একই যুক্তিতে তাঁদের বেতনের টাকাও কি ফেরত চাওয়া হবে? আর ফেরত না-দিলে তাঁদেরও সম্পত্তি কি বাজেয়াপ্ত করবে ইডি?
আইনজীবীদের মতে, সারদার থেকে সামান্য বেতন নেওয়া ব্যক্তিরও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নোটিস ইডি পাঠাতে পারে। আইন তাদের সে অধিকার দিয়েছে। তবে সামান্য বেতনভুক কর্মচারী, আর লক্ষ লক্ষ টাকা বেতন নেওয়া ব্যক্তির মধ্যে তফাত রয়েছে। এক আইনজীবী এ-ও জানান, “ইডি প্রথমে অ্যটাচমেন্টের নোটিস পাঠাবে, যেমন সারদা-সম্পত্তির ক্ষেত্রে হচ্ছে। এটা হল বাজেয়াপ্তকরণের প্রথম ধাপ। যাঁর সম্পত্তি, তিনি কিন্তু আদালতে যেতেই পারেন।”
এবং কোর্টে যদি তিনি প্রমাণ করতে পারেন যে, শ্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নায্য বেতন পেয়েছেন, তা হলে আদালত তাঁকে রেহাই দিতে পারে বলে জানিয়েছেন ওই আইনজীবী। এ প্রসঙ্গে আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের মন্তব্য, “বেতনের পুরো টাকা ফেরত দেওয়া মানে তো সেই ব্যক্তি বেগার খেটেছেন! অথচ ভারতীয় সংবিধানের ২৩ নম্বর ধারায় বলা আছে, কাউকে বেগার খাটানো যাবে না। কুণাল ঘোষ বা রজত মজুমদারদেরও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে, কী ধরনের শ্রম দিয়ে তাঁরা মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করেছেন।”
বস্তুত আইনজীবীদের একাংশের অভিমত, শ্রম-বেতন সামঞ্জস্যের প্রশ্ন উঠলে কুণাল-রজতের মতো লোকজনের পক্ষে আদালতকে সন্তুষ্ট করা মুশকিল। কারণ, সাধারণ ভাবে এক জন যত টাকা বেতন পেতে পারেন, সারদা থেকে তার বহু গুণ বেতন নিয়ে গিয়েছেন ওঁরা। এখানে প্রশ্ন উঠছে, শুভাপ্রসন্ন বা শান্তনু ঘোষদের ক্ষেত্রেও কি তা-ই হবে? ওঁরা সুদীপ্ত সেনকে সংস্থা (বৈদ্যুতিন চ্যানেল বা মোটরবাইক কারখানা) বেচে টাকা নিয়েছেন। শ্রমের বিনিময়ে নয়। তা হলে ওঁদের থেকে টাকা ফেরত চাওয়ার পিছনে যুক্তি কী?
এখানে হস্তান্তর-মূল্যে ‘স্বচ্ছতা’র প্রশ্ন তুলছেন ইডি-অফিসারেরা। ওঁদের ব্যাখ্যা: যে সংস্থার বাজারদর ছিল দশ টাকা, সুদীপ্তকে চাপ বা হুমকি দিয়ে সেটি কুড়ি টাকায় কিনতে বাধ্য করা হয়েছিল। এর ফায়দা লুটেছে সমাজের বিশেষ এক শ্রেণির মানুষ। সংস্থাগুলিকে এখন বাজারে নিলাম করলেও খুব সামান্য দাম মিলবে বলে ইডি-অফিসারদের ধারণা। তাঁরা জানিয়েছেন, বাজারদরের তুলনায় যত বেশি দামে কোম্পানি কিনতে সুদীপ্তকে বাধ্য করা হয়েছিল, সেই বাড়তি টাকা এ বার বিক্রেতার কাছে ফেরত চাওয়া হবে।
টাকা ফেরাতে না-পারলে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পথেই হাঁটতে চাইছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy