হোটেলে বসে সেই অভিশপ্ত দিনটির কথা বলে চলেছেন তাশি শেরপা। কাঞ্চনজঙ্ঘা মূল শৃঙ্গ জয় করে ফের পশ্চিম শৃঙ্গের দিকে পা বাড়ানো চার জনের দলটির একমাত্র ফিরে আসা সদস্য। দলের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ হওয়ার দরুণ তাশিই ছিলেন অভিযানের নেতা। তিনিই এখন ছন্দার দুর্ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী।
মধ্য তিরিশের ছোটখাটো চেহারা, শান্ত চোখ। বিষাদ আর চাপা আতঙ্কের মধ্যেও মুখের হাসিটুকু একেবারে মিলিয়ে যায়নি।
ছন্দারা পড়ে যাওয়ার পর তাশিই ২১ মে দুপুরে বেসক্যাম্পে ফিরে এসে দুর্ঘটনার খবর দিয়েছিলেন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ত্রস্ত তাশির মুখ থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া বিবরণ শুনে রাজীব ভট্টাচার্য (মূল শৃঙ্গ অভিযানের সদস্য) ধরে নিয়েছিলেন, তুষারধসের মুখে পড়েই হারিয়ে গিয়েছেন ছন্দারা। তাঁর বয়ান ছিল, ক্লান্ত ছন্দা প্রথমে পা হড়কেছিলেন। গোড়ায় তাঁকে আটকে দিয়েছিলেন তেমবা। কিন্তু তার পর সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই প্রবল তুষারধস এসে দড়ি ছিঁড়ে তিন জনকে নিয়ে খাদে মিলিয়ে যায়।
এ দিন বিকেলে কিন্তু তাশি পরিষ্কার বলছেন, আলাদা করে কোনও তুষারধসের সামনে পড়েননি তাঁরা। বরং পা পিছলে পড়তে পড়তেই পাহাড়ের গা থেকে খসে পড়েছিল বরফের তাল। ছন্দার সঙ্গে একই দড়িতে বাঁধা অবস্থায় তাঁর সঙ্গেই পড়ে গিয়েছিলেন দাওয়া ওয়াংচুক এবং নিম্মা তেমবা।
ছন্দার সঙ্গে গত প্রায় চার-পাঁচ বছর ধরে পাহাড়ে যাচ্ছেন তাশি। এভারেস্ট অভিযানেও সঙ্গে ছিলেন। নিজের বাড়ি দার্জিলিংয়ে। এখন কাঠমান্ডুতে রয়েছেন, উদ্ধারকাজে সাহায্য করছেন। বিভিন্ন পবর্তারোহণ সংস্থার হয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত তাশি ছন্দার নাড়িনক্ষত্র জানেন।
ছন্দা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, শৃঙ্গ
না ছুঁয়ে ফিরলে পরের বার থেকে
আর স্পনসর পাব না।
তাশি শেরপা
ছন্দার ক্ষমতা-দুর্বলতা কিছুই অজানা নয় তাঁর। একসঙ্গে এভারেস্ট-লোৎসে জয় করার পরে এ বার ছন্দা যখন একসঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘারও দু’টি শৃঙ্গ জয় করার অনুমতি বার করতে চাইছিলেন, তখন থেকেই কিন্তু আপত্তি করে আসছিলেন তাশি। বারবার ছন্দাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয় পা রাখা এভারেস্টে চড়ার চেয়েও অনেক অনেক বেশি কঠিন। তার জন্য অমানুষিক শারীরিক সক্ষমতা প্রয়োজন। সেটা সাধারণ মানুষের থাকে না। তাশির কথায়, “ছন্দাকে নিজের বোন বলেই মনে হতো আমার। ও-ও আমাকে ডাকত দাজু (নেপালি ভাষায় যার অর্থ দাদা) বলে। কোনও অহঙ্কার ছিল না ওর মধ্যে। ছিল শুধু জেদ। আর সেই জেদেই...।”
১৮ মে কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল শৃঙ্গে পা রাখেন ছন্দা-তাশি-টুসি-রাজীব-দীপঙ্কররা। ওই দিনই সন্ধেয় গোটা দলটা নেমে আসে সামিট ক্যাম্পে। ১৯ তারিখ রাত দশটা নাগাদ ইয়ালুং কাং-এর পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন ছন্দা। সঙ্গে তাশি, দাওয়া আর তেমবা। দীপঙ্কর এবং টুসি তার আগেই সামিট ক্যাম্প ছেড়ে বেসক্যাম্পের পথে রওনা দিয়েছেন। রাজীব একা থেকে গিয়েছিলেন সামিট ক্যাম্পে।
মূল শৃঙ্গ ছুঁয়ে আসার ক্লান্তি সঙ্গে নিয়ে ইয়ালুং কাং-এর মতো খাড়া বিপদসঙ্কুল পথে পা বাড়ানোটা এমনিতেই ছিল ঝুঁকির। সেই সঙ্গে তাশির বিবরণ বলছে ওই পথে সফল অভিযান যে হেতু খুব কম হয়েছে, তাই ঠিক কতটা দড়ি সঙ্গে রাখা উচিত, সে ব্যাপারে খুব পরিষ্কার আন্দাজ ছিল না কারওরই। একটি কোরীয় দলের রিপোর্ট বলেছিল, ৭০০ মিটার দড়ি দরকার। আরও ৫০০ মিটার বেশি দড়ি নিয়েছিলেন ছন্দারা। তাশি জানাচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত তাতেও কুলোয়নি। দড়ি ফুরিয়ে যাওয়াটাও যে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ, সেটা তাশির বয়ান থেকে স্পষ্ট।
তাশি বলেন, “কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল শৃঙ্গে রওনা দেওয়ার আগে ১৬ তারিখ রাতেই ইয়ালুং কাং-এর পথে পাহাড়ে খানিকটা দড়ি আগাম লাগিয়ে রেখে এসেছিলাম আমি আর তেমবা।” বড় বড় অভিযানে এমনটাই হয়ে থাকে। শেরপারা আগাম গিয়ে চড়ার পথ খুঁজে দড়ি লাগিয়ে ‘রুট ওপেন’ করে দিয়ে আসেন। ১৯ তারিখ রাতে ওই আগাম তৈরি করা পথ পেরোনোর পর বাকি রাস্তাটা দড়ি লাগাতে লাগাতে ছন্দাদের নিয়ে এগোচ্ছিলেন তাশি। বারো ঘণ্টারও বেশি সময় পাহাড় ভাঙার পর ২০ তারিখ বেলা ১২টা নাগাদ ফুরিয়ে যায় দড়ি।
তাশি বললেন, “দড়ি ফুরিয়ে যেতেই আমি ফেরার কথা বলি।” দড়ি ছাড়া ওই পথে এগোলে বিপদের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু ছন্দা রাজি হননি। তাশির কথায়, “ফিরতে হবে শুনেই আপত্তি জানায় ছন্দা। আমি বোঝাতে গেলে কেঁদে ফেলে ও। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, শৃঙ্গ না ছুঁয়ে ফিরলে পরের বার থেকে আর স্পনসর পাব না।” পাহাড়ে চড়ার নিয়ম বলে, দলের নেতার সিদ্ধান্ত মানতে হয় সকলকেই। কিন্তু ছন্দার জেদের কাছে হাল ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হয়েই আরও একটু এগোনোর সিদ্ধান্ত নেন তাশি। নীচে লাগানো দড়ি খুলে এনে উপরে লাগান। এই করেই চড়া হয় আরও ৩০০ মিটার। শৃঙ্গ তখন খুবই কাছে। সময় বেলা তিনটে। কিন্তু বাদ সাধে আবহাওয়া। চার পাশ সাদা করে তুষারঝড় শুরু হয়ে যায়। এ বার আর কিছুতেই ঝুঁকি নিতে চাননি তাশি। বললেন, “ছন্দা আবারও কাঁদছিল। বলছিল, নীচে গিয়ে কী জবাব দেব আমি?” তাশি বুঝিয়েছিলেন, প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে কোনও জবাব দেওয়া যায় না। তবু শেষ মুহূর্তে ফিরে আসাটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না ছন্দা। যে কোনও কিছুর শেষ দেখে ছাড়াটাই ওঁর স্বভাব ছিল। কিন্তু আবহাওয়া বুঝিয়ে দিচ্ছিল, পিছিয়ে আসা ছাড়া গতি নেই।
ফেরার পথে আবারও সমস্যা হয়ে দাঁড়াল দড়ি। তাশি জানালেন, কিছুটা নামার পর খানিকটা জায়গায় কোনও দড়ি ছিল না। কারণ ওঠার পথে ওখান থেকেই দড়ি খুলে দ্বিতীয় বার লাগিয়েছিলেন তাশি। ফেরার পথে খারাপ আবহাওয়ার কারণে দ্রুত নামার তাড়া ছিল। তাই নতুন করে পাহাড়ের গায়ে দড়ি লাগানোর সময় ছিল না। ফলে ক্লান্ত শরীরে ৮০ ডিগ্রি খাড়া ওই সরু বিপদসঙ্কুল জায়গাটা ‘রানিং বিলে’ পদ্ধতিতে নামতে বাধ্য হন তাঁরা। ওই উচ্চতায় যেটা কখনওই কাম্য নয় বলে মনে করেন অভিজ্ঞ পর্বতারোহীরা।