অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
মশা হুশ
মাঝরাতে ক্যানেস্তারা
যারে মশা যা/ পিঠ কুরি কুরি খা/ বড় ঘরের বড় মশা, মশা মাতলা লো/ মশা আসে হুহু হুহু/ যাবু কি না যাবু কহু কহু...
কালীপুজো শেষ হতেই নিশুত রাতে গাঁয়ের পিলে চমকে দিয়ে ক্যানেস্তারা পেটাতে বেরিয়ে পড়েছে এক দল ছেলেবুড়োরা। গায়ে জবজবে করে মাখা সরষে বা কচড়ার তেল। মুখে তুবড়ির মতো এই বিচিত্র ছড়া। এক সময়ে কার্তিক মাসে দীপান্বিতা কালীপুজোর পরে এবং প্রতিপদের ভোর হওয়ার আগে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যেত জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জে। যার লৌকিক নাম ছিল ‘মশাখেদা’। এক দলের বিশ্বাস ছিল, এই ভাবে মশা তাড়ালে আগামী কয়েক মাস হুলের হাত থেকে রেহাই মিলবে। যদিও আসলে শীত পড়ার আগে যখন মশাবাহিত রোগের প্রকোপ তুঙ্গে, তখন গাঁয়ের সকলকে সাবধান করাই ছিল লক্ষ্য। বর্ষার পরে মশাদের দাপট এ বঙ্গদেশে এখনও অক্ষুণ্ণ। আগে যা-ও বা ছিল ম্যালেরিয়া, এখন দোসর হয়েছে ডেঙ্গি। কিন্তু ক্যানেস্তারার দিন গিয়েছে। মশাধূপ, তেল, মলম— কত কী এসেছে। প্রচারের ক্যানেস্তারা বাজছে টিভি-রেডিওয়। অর্থাৎ, গল্পটা মোটেও পাল্টায়নি। তবে সত্যি করে ক্যানেস্তারা পেটানোও টিঁকে রয়েছে কিছু জায়গায়। পশ্চিম মেদিনীপুরে বেলিয়াবেড়ার ভোল, বামুনদাঁড়ি বা সাঁকরাইলের দিগার বাঁধ, হাড়পৈড়্যার মতো হাতে গোনা কয়েকটি গ্রামে এখনও সচকিত হয়ে ওঠে কালীপুজোর রাত। ভোল গ্রামের মৃত্যুঞ্জয় ঘাঁটাই, হাড়পৈড়ার রমানাথ খিলাড়িদের মতে, মশাখেদার সূচনা অন্তত কয়েকশো বছর আগে। এখন অবশ্য দলে বেশি লোক পাওয়া যায় না। “কিন্তু ছোটবেলায় দেখেছি, মশা খেদাতে গোটা গ্রামের ছেলেবুড়ো হাজির হত। ছড়া শোনার জন্য জানলায় কান পেতে রয়েছেন মা-পিসিমারা। বাজি-পটকা ফাটলে যে ঠাকুর্দা রেগে কাঁই হতেন, তিনিও কিন্তু ক্যানেস্তারার বিকট শব্দ শুনে দু’হাত কপালে ঠেকাতেন”— মনে পড়ে রমানাথের। নিয়ম ছিল, সূর্যোদয়ের আগেই মশাখেদার দল বাড়ি ফিরে যাবে। বাড়ি ফেরার পরে ছেলেদের হাতে-পায়ে তেল মালিশ করে দেবেন মা-ঠাকুমারা। অড়হর পাতা, শশা ও হিং দিয়ে তৈরি এক ধরনের পাঁচনও খাওয়ানো হবে। সেই পাঁচনে মশার হুলের বিষও কাত, এই ছিল বিশ্বাস। ঝাড়গ্রামের লোকসংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “এ ভাবে তো একটিও মশা নির্মূল হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মশাকে উপলক্ষ করে এটি কালীপুজো ও বাঁদনা পরবের আনুষঙ্গিক লৌকিক বিনোদন। এতে মূলত দরিদ্র মূলবাসীদের ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটত।” জঙ্গল আছে জঙ্গলে। মশারা মশাদের জায়গায়। বিশ্বাস আর বিনোদনের সংজ্ঞাগুলোই শুধু বদলে গিয়েছে।
কালী কলরব
সে যাদবপুরও নয়, শহর কলকাতাও নয়। বরং সোশ্যাল মিডিয়া ভাসিয়ে, বাকি আর সব মিডিয়াকে বেশ কয়েক দিন দুলিয়ে হোককলরব পৌঁছল মুর্শিদাবাদে কালীর দুয়ারে। সেই কবে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় কলরব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ‘কালী কালী বলো সবে’। বহরমপুরের বাগানপাড়া অ্যাথলেটিক ক্লাব সেই ভজনাতেই নিয়ে এসেছেন যাদবপুরী ছোঁয়াচ। গোটা মণ্ডপ কালোয়-সাদায় কলরব করে উঠেছে। পুজো কমিটির অন্যতম কর্তা সাবিরুদ্দিন শেখ বলেন, “আমাদের টুবাইয়ের মাথাতেই প্রথম ব্যাপারটা আসে। আমরাও ভেবে দেখলাম, যাদবপুরের পাশে বহরমপুর কেন দাঁড়াবে না?” চটপট ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে ফেলা হয় যাদবপুরের আন্দোলনের বিভিন্ন ছবি। বড়-বড় ফ্লেক্স ছাপিয়ে তা দিয়ে সাজানো হয় মণ্ডপ। ঠাকুর দেখতে আসা জনতা চমকে পড়ে ফেলে “পুলিশ তুমি যতই মারো, ছাত্র-যুব জ্বলবে আরও।” কালীপুজোর সময়েই ফেসবুকে সেই ছবি দেখে যাদবপুরের পড়ুয়ারাও উচ্ছ্বসিত। গুচ্ছ ‘লাইক’ দিয়ে তাঁরাও লিখে দেন “হোক কলরব!”
কীর্তনের ভুবন
ভারতবর্ষে দু’ধরনের পদ ছিল-- কাব্যপদ এবং গেয়পদ। গেয়পদের রচয়িতারা সুর, তাল, ভাব ও রসের সমন্বয়ে নিজেদের পদ পরিবেশন করতেন। তাকে ‘প্রবন্ধগান’ও বলা হত। লোকগান আর প্রবন্ধগানের মাঝামাঝি আর একটি ধরন প্রচলিত ছিল। তার নাম প্রকীর্ণ গান। যার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে। পদাবলী কীর্তন সেই তারই উত্তরসূরি। কীর্তনের শিকড়ের খোঁজ দিল নবদ্বীপে রাজ্য তথ্য সংস্কৃতি বিভাগ আয়োজিত সদ্যসমাপ্ত প্রথম কীর্তন উৎসবের প্রদর্শনী। সেন আমল, জয়দেবের গীতগোবিন্দ হয়ে সুলতানি আমলে সংস্কৃতির ভেঙে পড়া ও ফের চৈতন্যের আবির্ভাবের সঙ্গে নবধারায় কীর্তনের বিকাশ ধরা হয়েছিল। মানচিত্র ও তালিকা সহযোগে গরানহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটির মতো সব ক’টি ধারার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বা ব্রহ্ম হরিদাস, নরোত্তম দাস, রসিক দাস, শ্যামানন্দের মতো কীর্তনিয়াদের দুর্লভ আলোকচিত্র ছিল বড় পাওনা।
ভেজা আখর
‘কে কার পুত্র ছিল, কে কার কন্যা?/ সে সব তুচ্ছ এখন/ রাজনীতি নেমেছেন মাঠে।’ বড্ড সত্যি মনে হয় কথাগুলো, যখন মাস্কেটের গুলিতে বীরভূমের কোনও গ্রামে লুটিয়ে পড়ে বছর উনিশের তরতাজা ছেলে। বা, ধর্ষণ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কিশোরীর দেহ। এই সব মৃত্যু, আগুন, রাজনীতি জড়িয়ে আছে গৌতম সরকারের কবিতার আখরে। আসলে জড়িয়ে আছে মানুষ আর মানুষের প্রতি তাঁর অবিরল ভালবাসা। তাঁর কবিতা সংক্ষোভে উচ্চকিত হয় না, বরং বিষাদে ডুবে যায়। ধরে রাখে শহিদের তর্পণ। মন্ত্রের মতো বলে ‘...তুমিও যদি/ কিছু ভুলে না থাকো।/ প্রাণপণে/ ধরে রাখো/ এই মায়াজল।’ শ্রমজীবী হাসপাতালের সর্বক্ষণের কর্মী গৌতমের কবিতার বই শ্রাবণে-আশ্বিনে (বৃশ্চিক) হয়তো আরও সুখপাঠ্য হতে পারত মুদ্রণপ্রমাদ এড়ানো গেলে। তবু ‘অক্ষরের আড়ালে কিছু প্রাচীন মেঘ জমে আছে’ জেনে ভাললাগা এড়ানো যায় না।
মলয় বিদ্যুৎ
তাঁর ক্ষুধা এখনও মেটেনি। পঁচাত্তরে পৌঁছে এখনও তিনি সমান তরুণ, সমান সবল। অবিরল লিখে চলেছেন, প্রকাশ করে চলেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস। মূলত নয়া প্রজন্মের বিচরণ ক্ষেত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি এবং ভক্তসংখ্যাও ঈর্ষার উদ্রেক করার মতো। তাঁর অতি পরিচিত ও চর্চিত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ অবলম্বনে ১২ মিনিটের একটি ছবিও তৈরি করে ফেলেছেন ব্যারাকপুর-খড়দহের কয়েক জন স্বশিক্ষিত তরুণ-তরুণী। নিজেদের ট্যাঁকের টাকা খরচ করে, নিজেরা ক্যামেরা চালিয়ে, নিজেরাই সম্পাদনা করে দেশ-বিদেশের বেশ কিছু প্রদর্শনীতে ছবিটি দেখিয়েও ফেলেছেন পূরব, মৃগাঙ্কশেখর, নিবেদিতারা। কবি নিজে যদিও ছবিটি দেখেননি। মঙ্গলবার, ১১ কার্তিক নিজের জন্মদিনে মলয় বললেন, “আমি ওদের বলেছি, আমার কবিতা যে ভাবে ইচ্ছা ইন্টারপ্রেট করো। শুনেছি, ওটা অন্য ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। তাতে ক্ষতি নেই। যাঁর যে ভাবে ইচ্ছে ব্যাখ্যা করুন।” (সঙ্গের ছবিতে মলয় রায়চৌধুরী, উপরে চলচ্চিত্রের একটি স্থিরদৃশ্য)
সম্মেলন স্মরণে
বঙ্গীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন।
১৯০৭ সালের কথা। সে বছর ৩ ও ৪ নভেম্বর বহরমপুর শহরের কাশিমবাজারে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর রাজপ্রাসাদে বসেছিল বঙ্গীয় সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন। উদ্যোক্তা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আগামী ২ নভেম্বর, রবিবার বহরমপুর শহরের অমৃতকুম্ভের মহলাকক্ষে তারই উদ্যাপন করতে চলেছে ‘বাংলার কথামুখ’ ও বহরমপুর ইয়ুথ কয়ার। আলোচনা, সঙ্গীত এবং আবৃত্তি ছাড়াও থাকছে স্বরচিত কবিতা পাঠ।
বনকলম
শিকার অনেকেই করেছেন, সকলেই জিম করবেট হননি। সেটা হয়তো মনে ছিল সমীর মজুমদারের। জিম যতটা অমর হয়ে রয়েছেন যতটা লেখনীর জন্য, হয়তো বন্দুকের জন্য নয়। জঙ্গলের পেশায় জীবন জড়িয়ে ফেলা সমীরও সেই রাস্তা নিয়েছেন। অতশত না ভেবেই।
বন দফতরের অফিসার এ দেশে কম নেই। মেদিনীপুরের সমীর তাঁদেরই এক জন। ১৯৮৭ সালে জলপাইগুড়িতে ওয়াইল্ড লাইফ স্কোয়াডে বনাঞ্চল আধিকারিক হয়ে যোগ দেওয়া ইস্তক কোচবিহার, আমবাড়ি-ফালাকাটা, শালুগোড়ার মতো বিভিন্ন রেঞ্জে সম্মুখীন হয়েছেন নানা রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার। খদ্দের সেজে জলপাইগুড়ির ক্রান্তিতে মাফিয়াদের ডেরা থেকে হাতির দাঁত উদ্ধার বা মালবাজারের জঙ্গলে শীতরাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত দুই হাতির দাঁত কাটতে গিয়ে হস্তিদলের কাছে ঘেরাও হয়ে পড়া, চোরাই কাঠ আটক করার পরে আবাসন থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া— কত যে গল্প তাঁর ঝুলিতে।
সেই সব গল্পই এক-এক করে লিখে ফেলছেন সমীর। বদলি হয়ে ঘুরতে-ঘুরতে এখন তিনি পুরুলিয়ার এডিএফও। দফতরের কাজ, জঙ্গলে যাওয়া, হাতি তাড়ানো, গ্রামবাসীদের ক্ষোভ সামাল দেওয়ার ঝক্কি সামলেও লেখা চালিয়ে যাচ্ছেন সমানে। প্রথম গল্পের সংকলন জঙ্গল থেকে জঙ্গলে, দ্বিতীয়টির নাম আবার জঙ্গলের জন্য। সমীর বলেন, “রেঞ্জারের চাকরিতে নানা হাড়হিম করা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। এমন পরিস্থিতিতেও পড়েছি যে মনে হয়েছে, বেঁচে ফিরতে পারব না। আশ্চর্য কিছু চরিত্রও পেয়েছি। কিছু চরিত্রের মুখে মুখোশ আঁটা। সবই লিখছি। কিছু গোপন করছি না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy