Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
বানভাসি অর্ধেক বাংলা

রাজ্য জুড়ে মৃত ১৬, জেলা সফরে মমতা

দুর্ভোগের ভিতটা তৈরি হয়েই ছিল। শুক্রবার রাত থেকে বৃষ্টির দাপট বাড়তেই বানভাসি হয়ে পড়ল গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সরকারি হিসেব বলছে, দক্ষিণবঙ্গের ১২ জেলার ১৮১ ব্লকে এখন বন্যা পরিস্থিতি। ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ১৮ লক্ষ মানুষ।

প্রবল বর্ষায় ফুঁসছে গঙ্গা। ডুবেছে হাওড়ার জেটিও। শনিবার দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।

প্রবল বর্ষায় ফুঁসছে গঙ্গা। ডুবেছে হাওড়ার জেটিও। শনিবার দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

দুর্ভোগের ভিতটা তৈরি হয়েই ছিল। শুক্রবার রাত থেকে বৃষ্টির দাপট বাড়তেই বানভাসি হয়ে পড়ল গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সরকারি হিসেব বলছে, দক্ষিণবঙ্গের ১২ জেলার ১৮১ ব্লকে এখন বন্যা পরিস্থিতি। ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ১৮ লক্ষ মানুষ। ১ লক্ষ ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন ত্রাণ শিবিরে। ২ লক্ষ হেক্টরেরও বেশি চাষের জমি ক্ষতিগ্রস্ত। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে জলে ডুবে, দেওয়াল ধসে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনটি শিশু-সহ ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। জলে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ দু’জন।

হাওয়া অফিস বলছে, বাংলাদেশে থাকা গভীর নিম্নচাপটি এ দিন সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছে। তার জেরে আজ, রবিবারও কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। তবে সোমবার থেকে আবহাওয়ার উন্নতির সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ।

এ দিন বিকেল থেকেই রাজ্যের প্লাবিত এলাকা পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন তিনি যান হাওড়া ও হুগলিতে। কাল, সোমবার তাঁর উত্তর ২৪ পরগনার হাবরায় যাওয়ার কথা। বৃহস্পতিবার এই হাবরাতেই ত্রাণ দিতে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। শাসক দলের মদতেই হাবরায় তাঁকে হেনস্থা করা হয় বলে রূপার অভিযোগ। আবার ঠিক পরের দিন মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, শুধু রাজ্য সরকারই ত্রাণ বিলি করবে। এই দুই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছেন বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের মত, সেই আক্রমণ মোকাবিলায় মাঠে নেমে মুখ্যমন্ত্রী খুব ভেবেচিন্তেই হাবরা সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ বলছেন, মমতা কেন লন্ডন সফর ছেঁটে তড়িঘড়ি ফিরে এলেন, শনিবার বিকেলের জেলা সফরই তার প্রমাণ দিচ্ছে।

এ দিন রাস্তার একাধিক জায়গায় দাঁড়িয়ে দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আবার স্থানীয় বিডিও-কে দেখতে না পেয়ে মেজাজও হারিয়েছেন। পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এত ভারী বর্ষা দীর্ঘদিন হয়নি। সঙ্গে ভরা কোটাল। ঝাড়খণ্ডেও ডিভিসি থেকে জল ছাড়ছে। জল না ছেড়ে হয়তো উপায় নেই। তবু ওদের বলেছি একটু বুঝে বুঝে ছাড়তে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কারও হাতে থাকে না।’’

হাওয়া অফিসও বলছে, এক লপ্তে এত বৃষ্টি অনেক দিন হয়নি। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত কলকাতায় ১৪৩.২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গত দশ বছরের নিরিখে এক দিনের মধ্যে যা দ্বিতীয় সর্বাধিক। এমন প্রবল বৃষ্টির জেরে নদিয়া, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ বিভিন্ন জেলায় একের পর এক ব্লক জলে ডুবে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকাও জলমগ্ন। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্য জুড়ে ‘বন্যার মতো’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় মন্ত্রীরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর হিসেব অবশ্য বলছে, ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা সাড়ে ছ’লক্ষ। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে পানীয় জল, ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনকে বলা হয়েছে সাহায্য করতে।

জেলা সফরের সময় হুগলির পুড়শুড়ার বিডিও অফিসে ত্রাণ নিয়ে বৈঠক চলাকালীন
জেলা প্রশাসনের কর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন উত্তেজিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শনিবার মোহন দাসের তোলা ছবি।

তবে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন ফের জানিয়েছেন, ত্রাণ বিলির কাজ রাজ্যই করবে। কেন্দ্রের সাহায্যের অপেক্ষায় তাঁরা থাকবেন না। রাজ্য সরকার কেন্দ্রকে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবে। তাঁর প্রশ্ন, দার্জিলিঙে ধসে তো প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। কেন্দ্র কী সাহায্য করেছে? মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘আমাদের গরিবের সংসার। তার মধ্যে যেটুকু যা আছে তা-ই নিয়ে মানুষের পাশে থাকছি।’’

এ দিন বিকেল সওয়া ৫টা নাগাদ হাওড়ার আমতার সরিয়লা-জোতকল্যাণে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। একটি অনুষ্ঠান-বাড়ি ভাড়া করে প্রশাসনিক বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিল জেলা তৃণমূল এবং জেলা প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রী ওই বাড়িতে ঢোকেননি। রাস্তাতেই জেলাশাসক এবং বিধায়কদের সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। ওই আয়োজনের জন্য ক্ষোভ প্রকাশও করেন। বলেন, ‘‘আমি এখানে এসেছি দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। বদ্ধ ঘরে বৈঠকের জন্য আসিনি।’’ জেলাশাসক শুভাঞ্জন দাসকে বলেন, ‘‘আমার কাছে সব খবর আছে। ত্রাণ বিলি ঠিকঠাক হচ্ছে না বলে কেউ কেউ আমার কাছে অভিযোগ করেছেন। ত্রাণের অভাব হবে না। আপনার বিডিওদের বলে দেবেন ত্রাণ বিলি নিয়ে যেন রাজনীতি না হয়। সব দুর্গতের হাতে যেন ত্রাণ পৌঁছয়। যদি তা না হয়, কাউকে ছেড়ে কথা বলব না।’’

আমতায় আসার পথে রানিহাটি এবং মানিকপীঠে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু আমতায় গিয়ে সেখানকার এক নম্বর ব্লকের বিডিওকে দেখতে না পেয়ে প্রচণ্ড রেগে যান। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘বিডিও কেন ত্রাণ দিচ্ছেন না? শুধু টিভিতে মুখ দেখাচ্ছেন! চাবকে লাল করে দেব!’’ এ বিষয়ে বিডিও গৌতম দত্তকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘‘আমি ওখানে ছিলাম না। উনি এ রকম বলেছেন বলে শুনিনি।’’

আমতা থেকে মুখ্যমন্ত্রী যান উদয়নারায়ণপুরে। রাজাপুরে ফের গাড়ি থেকে নেমে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তার পর হুগলির পুড়শুড়ায় ব্লক অফিসে গিয়ে ত্রাণ নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক করেন। সংবাদমাধ্যমকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক রং না দেখে প্রকৃত দুর্গতদের সাহায্য করতে হবে। প্রশাসনকে বলা হয়েছে, যত দিন দুর্গতেরা থাকতে চাইবেন, ক্যাম্প চলবে। মাছ-সব্জি-সহ চাষের ক্ষতি এবং রাস্তাঘাটের অবস্থা খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ, কেউ যেন রাস্তা বা রেল অবরোধ না করেন।

এ দিন নদিয়ার হরিণঘাটায় যান রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ত্রাণ দিতে এসেছি। কোনও রং দেখা হচ্ছে না।’’ বিরোধীরা অবশ্য এ দিনও মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ সংক্রান্ত নির্দেশকে কটাক্ষ করেছেন। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘সরকার যখন ত্রাণ নিয়ে পৌঁছতে পারছে না, তখন অন্য কেউ যাবে না, এটাই মুখ্যমন্ত্রীর মত। কিন্তু তাঁর উচিত ছিল, ত্রাণের জন্য সবাইকে আহ্বান জানানো।’’

মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফর সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত শহরে ফেরাকে সাধুবাদ জানিয়েও সূর্যবাবু বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর উচিত আকাশ থেকে বন্যা পরিস্থিতি দেখা। তা না করে তিনি যদি নিজের বাহিনী নিয়ে জেলায় জেলায় ত্রাণ-পর্যটনে যান, তা হলে ভালর বদলে মন্দ হবে।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, ‘‘উনি সারা রাজ্যেই যেতে পারেন। কিন্তু কে কোথায় যাবে না যাবে, তা নিয়ে বলার উনি কে?’’ একই সুরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘উনি হাবরায় যাচ্ছেন, ভাল কথা। মুখ্যমন্ত্রীর উচিত ছিল, বন্যা-পরিস্থিতির মোকাবিলায় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে নিয়ে কাজ করা।’’

এ দিন সকালে বিভিন্ন জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়ে ‘ভিডিও কনফারেন্স’ করেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। প্রশাসন সূত্রে খবর, রবিবার জলমগ্ন এলাকায় যেতে পারেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। শুধু বর্ধমান জেলাতেই এখন প্রায় দু’লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। পূর্ব মেদিনীপুরের ৫২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫২৮টি গ্রামে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। ধান খেত, ধানের বীজতলা, সব্জি, পান বরজ, ফুল চাষের জমি ও মাছের ভেড়ি— সব জলের তলায়। জলাধারের ছাড়া জল এবং অতি ভারী বৃষ্টিতে পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘাটালের একাংশে বানভাসি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন সবং ও পিংলাতেও।

বীরভূমের লাভপুরের হাতিয়া পঞ্চায়েতের কিছু এলাকায় ময়ূরাক্ষীর জল ঢুকে পড়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, বাগদা, গাইঘাটা, উত্তর ব্যারাকপুর, নৈহাটি, কামারহাটি, পানিহাটি, আগরপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জলের তলায়। হাবরা-১ ব্লকের বেড়গুম-১,বেড়গুম-২, কুমড়ো পৃথিবা এবং মছলন্দপুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কিছু গ্রাম জলমগ্ন হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ক্যানিং মহকুমার প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বাড়ি ভেঙে পড়েছে। নদিয়া-মুর্শিদাবাদে নতুন করে বেশ কিছু এলাকায় জল ঢুকেছে। বহরমপুর-রামনগরঘাটের রাজ্য সড়কে নৌকো চলছে।

এ দিন জল জমেছিল মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রার পথেও। রাতে হুগলি থেকে কলকাতায় ফেরেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE