মগ্ন শিল্পী।—নিজস্ব চিত্র।
অনুভূতি আর অভিজ্ঞতাই এখন সম্বল একাত্তর বছরের বৃদ্ধের।
পলিথিনে ঢাকা খড়ের চালে ছাওয়া কুঁড়ের এক কোণে বসে এক মনে তিনি তখন কালী প্রতিমার পায়ের আঙুল গড়ছেন। বাইরে থেকে অচেনা গলা পেয়ে মুহূর্তে জন্য হাত থমকাল। বললেন, “ভিতরে আসুন। আমার দু’চোখ অন্ধ। কিছু দেখতে পাই না।”
কাজ করতে করতেই জানালেন, রুজির টানে বাধ্য হয়ে আজ এত বয়সেও প্রতিমা গড়তে হয়। অথচ দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারের সরিষা গ্রামে এক সময়ে এক ডাকে সকলে চিনতেন প্রতিমা শিল্পী কানাইলাল ভট্টাচার্যকে। তাঁর হাতের তৈরি প্রতিমা এক সময় গ্রাম ছাড়িয়ে পৌঁছতে যেত শহরের বিভিন্ন মণ্ডপে। সেই পেশা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তফাত্ একটাই, চোখে আর কিছুই দেখেন না বৃদ্ধ।
ছোট কুঁড়ে ঘরে ছেলে, পূত্রবধূ ও স্ত্রীকে নিয়ে কানাইবাবুর সংসার। সরিষা আশ্রম মোড়ে প্রতিমা তৈরি করে বিক্রির জন্য একটি ছোট দোকান ঘরও রয়েছে। স্মৃতি হাতড়ে বৃদ্ধ বললেন, “বিরাট সংসারে পেশায় পুরোহিত বাবার সামান্য আয়ে দিন গুজরান হত না। ক্লাস নাইনের পর পড়া ছেড়ে দিতে হল। তখন খুব জোর ১৪-১৫ বছর বয়স আমার।” পেটের দায়েই ওই এলাকার এক সময়ের বিখ্যাত প্রতিমা শিল্পী বজরতলা গ্রামের বাসিন্দা দুলাল চক্রবর্তীর কাছে প্রতিমা গড়ার হাতেখড়ি। বাকিটা ইতিহাস। তাঁর নিপুণ হাতে তৈরি ২০-২৫টির মধ্যে বেশ কিছু দুর্গা প্রতিমা প্রতি বছর ডায়মন্ড হারবার এলাকা ছেড়ে পাড়ি দিত কলকাতার বেহালা, দমদম এলাকার বড় মণ্ডপেও। কিন্তু বছর কুড়ি আগে আচমকাই তাঁর জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। স্মৃতি হাতড়ান বৃদ্ধ। জানান, খড় দিয়ে দুর্গা প্রতিমার কাঠামো তৈরি করছিলেন। দড়ি দিয়ে বাঁশের সঙ্গে কাঠামো টেনে বাঁধতে গিয়ে খড়ের কাঠি বাঁ চোখে ঢুকে জখম হন কানাইলালবাবু। চোখের চিকিত্সা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁ চোখের চিকিত্সা চলাকালীনই ডান চোখের দৃষ্টি কমে আসতে থাকে। পরে সেটিও নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু চোখ হারালেও পেশা এবং নেশা তাঁর পিছু ছাড়েনি। যে শিল্পে চোখের আন্দাজই প্রধান সম্বল, অনভ্যস্ত দৃষ্টিহীনতা তা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেনি। জন্মান্ধ না হয়েও অভিজ্ঞতা দিয়ে, শুধু স্পর্শ করে প্রতিমা তৈরি করেছেন রমরমিয়ে। তবে চোখ আঁকাতে অন্য শিল্পীদের উপরে নির্ভর করতেই হয় এখন। কখনও বা হাত লাগান স্ত্রী শক্তি।
এ বারে হরিণডাঙা গ্রামের একটি মাত্র পুজোর দুর্গা প্রতিমা গড়েছেন। অসুস্থতার জেরে লক্ষ্মী প্রতিমা গড়তে না পারলেও নিজের হাতে পাঁচটি কালী প্রতিমা বানিয়েছেন কানাইলালবাবু। সংসার চলে বহু কষ্টে। রোগে ওষুধ কেনার সম্বল নেই। অথচ সরকারি কোনও সুবিধা জোটেনি। শক্তিদেবী বলেন, “আমরা দু’জনেই অসুস্থ। ছেলে একটা ছোট কারখানায় কাজ করে। যা আয় করে, তাতে সংসার চালানো খুবই কষ্টসাধ্য। আমাদের কপালে বার্ধক্য ভাতাও জোটেনি। আজ পর্যন্ত বিপিএল তালিকায় নাম উঠল না। যত বার পঞ্চায়েত-প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি, প্রতি বারই বলা হয়েছে, পরে এসো।” কানাইবাবু বলেন, “আমি একশো ভাগ প্রতিবন্ধী। অথচ বছরের পর বছর প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও কোনও সরকারি সাহায্য মেলেনি।”
ডায়মন্ড হারবার-২ এর বিডিও তীর্থঙ্কর বিশ্বাস বলেন, “বিপিএল তালিকায় নতুন করে নাম নথিভুক্তিকরণ এখন বন্ধ আছে।” প্রতিবন্ধী ভাতা বিষয়ে পঞ্চায়েতে ওই ব্যক্তি আবেদন করলে আমি জেলা প্রতিনিধিকে জানাব। উনি যোগাযোগ করলে শীঘ্রই সাহায্যের ব্যবস্থা হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy