সরকারি খাস জমিতে বেআইনি দখল।
যে মাতলা নদীকে ঘিরে এক সময়ে পুর শহরের মর্যাদা পেয়েছিল ক্যানিং, সেই মাতলাই মজে গিয়ে মৃতপ্রায়। তার চরে বহু ভূমিহীন মানুষ বসবাস শুরু করেন বহু কাল আগেই। জমি দখল করে রীতিমতো পল্লি বানিয়ে তোলা হয়েছে। নদীর বাঁধ কেটে হাজার হাজার বিঘে জমিতে জবরদখল করে মেছোভেড়ি গড়ে উঠেছে। এলাকার প্রবীণ মানুষজনের মতে, চরের জমিকে পরিকল্পনা মাফিক কাজে লাগিয়ে অনেক কাজ হতে পারত। যা প্রশাসনিক উদাসীনতার জন্যই সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিক পোর্ট ক্যানিংয়ের কার্যালয়-সংলগ্ন জমিতে এবং প্রাচীন বন্দর এলাকার জমিতে দখলদারেরা বসে গিয়েছে। ক্যানিং স্টেশনের আশপাশের এলাকাতেও কয়েকশো একর জমি চলে গিয়েছে দখলদারদের হাতে। ক্যানিং ১ ব্লকের মাতলা মৌজার ওই জমিতে বহু ঝুপড়ি, দোকানঘর, গুমটি, পাকাবাড়ি তৈরি হয়েছে। ফলে এক দিকে যেমন বহু বছর ধরে বহু টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, তেমনই শহরে অপরিকল্পিত ভাবে বসবাস বেড়ে চলায় বাসিন্দাদেরও নানা পরিষেবা নিয়ে দুর্ভোগের একশেষ হতে হয়।
দখলদারদের মদত দেওয়ার পিছনে আবার ডান-বাম দু’দলেরই বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছে শহরবাসীর একটা বড় অংশের। তাঁদের বক্তব্য, যে দল যখন ক্ষমতায় থেকেছে, তারাই দখলদারিকে প্রশয় দিয়েছে। অভিযোগ, যার পিছনে আর্থিক লেনদেন আছে। নিজেদের লোককে সরকারি খাস জমিতে বসানো হয়েছে ডান-বাম দু’আমলেই। দখল করা জমির উপরে বাড়ি বা দোকান তৈরি হওয়ার পরে তা মোটা টাকার বিনিময়ে দিব্যি হাত বদলও হচ্ছে। স্থানীয় মানুষের একাংশ মনে করেন, সরকারি ওই জমি যদি নিজেদের হাতে নিয়ে সরকার সেই জমিই গরিব মানুষকে পাট্টা দিত, তাতে এক দিকে যেমন বহু মানুষ বসবাসের আইনি স্বীকৃতি পেতেন, তেমনই সরকারের কোষাগারও ভোরত। আইনি স্বীকৃতি না থাকায় অনেককে নানা সময়ে জোর করে তুলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে। ওই জায়গায় আবার বসানো হয় নিজেদের দলের খাস লোককে। জবরদখল নিয়ে ভুরি ভুরি অভিযোগ শহর ক্যানিংয়ে।
ক্যানিং পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক তৃণমূলের শ্যামল মণ্ডল বলেন, “ক্যানিংয়ে ১০৪২ খতিয়ানের সরকারি খাস জমি নিয়ে একটা সমস্যা আছে। আগের বাম সরকার বিষয়টি নিয়েকিছুই করেনি। আমি বিধানসভার অধ্যক্ষের মাধ্যমে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। জানিয়েছি, ওই জমিতে বসবাসকারীদের পাট্টা দিয়ে এবং দোকানদারদের লিজ দিলে এসরকারের আয় যেমন বাড়বে, গরিব মানুষও উপকৃত হবেন।”
মাতলার চরে আইন ভেঙে তৈরি হয়েছে বহু মেছো ভেড়ি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সিপিএমের কৃষক সভার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দুলাল ঘোষ বলেন, “ওই জমির এক তৃতীয়াংশেরও বেশি এক সময়ে ব্যক্তি মালিকানা হিসাবে বেআইনি ভাবে নথিভুক্ত হয়েছিল। আমাদের সময়ে সেই জমি আমরা পুনরুদ্ধার করে ১০৪২ খতিয়ানের সরকারি খাস জমি বলে চিহ্নিত করি। পরবর্তী সময়ে ওই জমির জবরদখলকারীদের তা লিজও দিতে চাই। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হওয়ায় সে কাজ আর এগোয়নি।”
অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) সোমনাথ দে জানান, ১০৪২ খতিয়ানের জমি নিয়ে কিছুটা সমস্যা আছে। এ নিয়ে মহকুমা প্রশাসনের দফতরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সম্প্রতি বৈঠক করা হয়েছে। ওই জমি কী ভাবে পাট্টা দেওয়া যায় এবং রাজস্ব আদায় করা যায়, তা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। সার্ভে করা হবে।
সমস্যা আছে আরও। সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদ গঠনের পর থেকে ক্যানিংয়ে কয়েকটি পুকুর খনন ছাড়া আর বিশেষ কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি বলেই অভিযোগ মানুষের। মহকুমার প্রশাসনিক ভবনগুলি সবই চলে ভাড়া বাড়িতে। এত বছর বাদে সম্প্রতি মাতলার চরে প্রশাসনিক ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। মাতলার চরকে আরও নানা রকম ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারত বলে মনে করেন এখানকার মানুষ। ইকো ট্যুরিজম পার্ক তৈরির সম্ভাবনা ছিল। সুন্দরবনের অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসাবে ক্যানিংয়ে সুন্দরবনকে নিয়ে একটি মিউজিয়াম তৈরির দাবি বহু দিনের। যা পর্যটকদের নানা ভাবে আকর্ষণ করতে পারত। কিন্তু সে সব কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। সুন্দরবনে যে সব পর্যটক যাতায়াত করেন, তাঁদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে ক্যানিং শহরে সরকারি হোটেল গড়া যেতে পারত। কিছু বেসরকারি হোটেল আছে বটে, কিন্তু সেগুলির মান এতটাই খারাপ যে পর্যটকেরা নেহাত ঠেকায় না পড়লে রাত্রিবাস করেন না। তবে ক্যানিং এবং বাসন্তী সেতু হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা উন্নত হয়েছে সেটা মানেন সকলে।
সংস্কৃতি ও খেলাধূলার নানা ক্ষেত্রে ক্যানিংয়ের সুনাম ছড়িয়েছে। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাব আছে সেখানেও। এক সময়ে ডেভিড সেশুন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রয়াত জ্যোতির্ময় ধরের পরিচালনায় এখানকার গোবিন্দ টকিজে মঞ্চস্থ করা হয়েছিল রক্তকরবী নাটকটি। দর্শকদের দাবি মেনে পর পর দু’টি শো করতে হয়েছিল নাটকের কুশীলবদের। নন্দিনীর ভূমিকায় শিবানী ঘোষালের অভিনয়ের কথা এখনও মনে রেখেছেন নাট্যপ্রেমী মানুষ। ক্যানিং অমর সঙ্ঘ নাটক প্রতিযোগিতায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছে। শিবানী ঘোষাল ছাড়াও অঞ্জু মল্লিক, সত্য ঘোষ, পীযূষ রাউত, দেবব্রত ঘোষালদের অভিনয় মানুষের মনে গভীর ছাপ রেখেছে। এক সময়ে চিত্পুরের যাত্রাপাড়ায় বিরাট নামডাক ছিল ক্যানিংয়েরই অভিনেতা গুণসিন্ধু মণ্ডলের। এ ছাড়া সাহিত্য আসর বসে শহরে। আবৃত্তি ও নৃত্যে এখানকার ছেলেমেয়েদের নামডাক আছে।
কিন্তু এত সবের পরেও স্থানীয় শিল্পীদের অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। তাঁদের প্রধান দাবি, একটি স্থায়ী অডিটোরিয়ামের। কমিউনিটি হলও তৈরি হোক, চান তাঁরা। শিবানীদেবী বলেন, “ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে যেমন সরকারি ভাবে উদ্যোগ চোখে পড়ে, ঠিক তেমনটা অভিনয় জগতের জন্যও থাকা দরকার। দুঃখের বিষয়, এমন প্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ শহরে কলা-কুশীলবদের শিল্প প্রদর্শনের জায়গা নেই।” মহকুমাশাসক প্রদীপ আচার্য বলেন, “রবীন্দ্রভবন আর কমিউনিটি হলের দরকার আছে। সরকারি ভাবে তা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। জমির খোঁজ চলছে।”
খেলার জগতেও ক্যানিংয়ের নাম ছড়িয়েছে দিকে দিকে। হেমন্ত দেবনাথ, মহানন্দ নন্দী, দিপালী দাসেরা এক সময়ে সাঁতারে নাম করেছিলেন। কিন্তু ক্যানিংয়ে কোনও স্যুইমিং পুলই নেই। সেখানে ছোট পুকুরে সাঁতার কেটে অনুশীলন করতে হয় এখনও।
কলকাতার প্রথম ডিভিশন ফুটবল লিগে খেলে অনেকের নজর কেড়েছেন দিলীপ কয়াল, তিমির মণ্ডল, কার্তিক সাহারা। কিন্তু এখানে ভাল কোনও খেলার মাঠই নেই। ক্লাব কর্তৃপক্ষগুলির অভিযোগ ভুরি ভুরি। মাতলার চরে এক সময়ে স্টেডিয়াম তৈরির উদ্যোগ করেছিল বাম সরকার। এ আমলে তা শুরু হলেও কাজ বিশেষ এগোচ্ছে না বলেই অভিযোগ।
এত সব অতৃপ্তিকে সঙ্গী করেই আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ক্যানিং।
(শেষ)
—নিজস্ব চিত্র।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে বলার থাকলে জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-ক্যানিং’।
চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-১।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। www.facebook.com/anadabazar.abp
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy