Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ধর্মগোলায় ধান রেখে নিশ্চিন্ত ছিলেন চাষি

জলে-জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা গোসাবাকে নানা ভাবে আধুনিক করে তুলতে চেয়েছিলেন হ্যামিল্টন সাহেব। তিরিশের দশকে যখন ভারতের কৃষিকাজ একেবারেই মানব-নির্ভর, হ্যামিল্টন সাহেব বিলেত থেকে ট্র্যাক্টর, পাম্প মেশিন-সহ নানা যন্ত্রপাতি এনে চাষ-বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন গোসাবায়।

বন্ধ পড়ে দাতব্য চিকিৎসালয়।

বন্ধ পড়ে দাতব্য চিকিৎসালয়।

সামসুল হুদা
গোসাবা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৫ ০১:১২
Share: Save:

জলে-জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকা গোসাবাকে নানা ভাবে আধুনিক করে তুলতে চেয়েছিলেন হ্যামিল্টন সাহেব।

তিরিশের দশকে যখন ভারতের কৃষিকাজ একেবারেই মানব-নির্ভর, হ্যামিল্টন সাহেব বিলেত থেকে ট্র্যাক্টর, পাম্প মেশিন-সহ নানা যন্ত্রপাতি এনে চাষ-বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন গোসাবায়। সেই সব যন্ত্রপাতি মেরামতির জন্য হাতে-কলমে কাজও শেখানো হতো। ‘হ্যামিল্টন ট্রাস্টে’ সেই সব যন্ত্রপাতির অস্তিত্ব আজও মেলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথও হ্যামিলটন সাহেবের কাজকর্মের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কারন হ্যামিল্টন সাহেবের কাজকর্মে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমেরিকা থেকে পাশ করা কৃষি গ্র্যাজুয়েট রথীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনকে একই ভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আজ সবই অতীত।

হ্যামিলটন সাহেবের স্বপ্নের গোসাবায় পরবর্তী পর্যায়ে উন্নয়নের ধারা ততটা চোখে পড়ে না। হ্যামিল্টনের পরবর্তী সময়ে ‘রাঙাবেলিয়া টেগোর সোসাইটি’ এলাকার মহিলাদের নিয়ে তাঁতবোনা, মুরগি পালন, হাঁস পালন, সেলাইয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল। কারিগরি শিক্ষার উন্নত ব্যবস্থা এখনও গড়ে তোলা যায়নি। কয়েকটি স্কুলে অবশ্য স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার শিক্ষা, টেলারিং শেখানো হয়। এরফলে কিছু যুবক-যুবতী প্রশিক্ষণ পেলেও এলাকায় বেকার সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতাও কমেনি।

সুন্দরবনের ১০২টি দ্বীপের মধ্যে গোসাবা, রাঙাবেলিয়া ও সাতজেলিয়া দ্বীপে স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন সমবায় আন্দোলনের যে বাতাবরণ গড়ে তুলেছিলেন, তার কিছু নিদর্শন অবশ্য এখনও দেখা যায়। কৃষকদের উন্নয়নের স্বার্থে ১৯২৯ সালে ‘ধর্মগোলা’ পদ্ধতি চালু হয়েছিল। ধান কাটার মরসুমে চাষিরা ধান জমা দিতেন একটি জায়গায়। আশ্বিন-কার্তিক মাসে সেই ধান তাঁরা নিতে পারতেন। আবার ফসল উঠলে চার ভাগের এক অংশ বাড়তি দিয়ে পুরো ধান ফেরত দিতে হতো। এ ভাবে নিজেদের সম্পদ বাড়ত। বর্তমানে গোসাবার বাগবাগান এলাকায় একটি ধর্মগোলা রয়েছে। গ্রামের যুবকেরা ধর্মগোলায় সমবায়ের মাধ্যমে বহুমুখী কাজ করছেন। ১৯১৯ সালে হ্যামিল্টন সাহেব যে সমবায় ভাণ্ডার চালু করেছিলেন, সে রকমই ব্যবস্থা রয়েছে বাগবাগানে। সেখান থেকে স্থানীয় মানুষ তাঁদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে পারেন।


গ্যাসোফায়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রেরও একই অবস্থা।

১৯৩৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ৭৯ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন হ্যামিল্টন সাহেব। তাঁর সেই চিন্তাধারাকে পাথেয় করে গোপীনাথ বর্মন গোসাবায় সাহেবের এস্টেটের ডাক্তার হিসাবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি সাহেবের আদর্শকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। গ্রামে বিদ্যুতের জন্য ‘গ্যাসিফায়ার কো-অপারেটিভ সোসাইটি’কে জমি দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের নিয়ে ষাটের দশকের শেষ দিকে ‘ফিশারমেনস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ও গঠন করেন। গোসাবার আরামপুর, দুলকি, সোনাগাঁ ও অন্যান্য এলাকার জেলেদের নিয়ে এ ধরনের সমবায় গঠিত হয়। স্থানীয় পুকুর ও খালে মৎস্য পালন করার আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ মৎস্যজীবীদের প্রশিক্ষিত করা হয়। গোসাবা বাজার-সংলগ্ন খালে ডিম পোনা ও ধানি পোনা এনে বড় করা হতো এবং তা স্থানীয় মানুষকে সুলভ মূল্যে দেওয়া হতো। ভাল মানের কাঠ দিয়ে সাহেব বাংলোর সামনে এক সঙ্গে অনেক নৌকা তৈরি করে মৎস্যজীবীদের দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে অবশ্য ওই কো-অপারেটিভ টিম টিম করে চলছে।

গোসাবার লঙ্কা, তরমুজ-সহ নানা ফসলের কদর ছিল গোটা রাজ্যে। রাজ্যের বাইরেও যাদের সুনাম ছিল। কিন্তু এখন লঙ্কার চাষ আর তেমন ভাবে হয় না। তরমুজেরও ফলন নেই। আয়লার পর থেকে গোসাবার মাটিতে লবণের ভাগ মাত্রারিক্ত বেড়ে যাওয়ায় বহু ফসল আজ বিলুপ্তির পথে।

হ্যামিল্টন সাহেবের পুকুর খননের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তী সময়ে বহু মিষ্টি জলের পুকুর কাটা হয়েছিল গোসাবা দ্বীপে। আরামপুর, জটিরামপুর, পাখিরালা, রাঙাবেলিয়া প্রভৃতি জায়গায় এখনও দেখা মেলে পুরনো দিনের সেই সব পুকুর। তবে পরিকল্পনার অভাবে এবং উপযুক্ত সংস্কার না হওয়ায় সেই সব পুকুর আজ চাষিদের কোনও কাজে আসে না। ফলে বৃষ্টির জলের উপরে নির্ভর করে পুরনো প্রথাতেই চাষবাস চলে। বিকল্প সেচের ব্যবস্থা নেই। এলাকার মানুষকে নির্ভর করতে হয় প্রকৃতির উপরেই। রাজ্য সরকার সুন্দরবন এলাকায় ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পে পুকুর খনন ও খাল সংস্কার করে বৃষ্টির জল ধরে রেখে চাষের কথা বলে। ওই প্রকল্পে সুন্দরবন এলাকায় কিছু পুকুর খনন ও খাল সংস্কার করা হলেও আজও ওই প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আয়লা পরবর্তী সুন্দরবনে নদীর নোনা জল ঢুকে জমি উর্বরতা হারিয়েছে। গোসাবা তথা সুন্দরবনে বিকল্প চাষের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে চাষ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। অনেকে কাজের তাগিদে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা নদী-খাঁড়িতে মাছ ধরতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বাঘ, কুমিরের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। অনেকে প্রাণ হারাচ্ছেন। অনেকে নদীতে মীন ধরে কোনও মতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মাছ ধরতে গিয়ে মৎস্যজীবীরা প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলদস্যুদের আক্রমণের মুখোমুখি পড়েন। ১৪টি পঞ্চায়েত এলাকায় চাষ-বাস, নদী-খাঁড়িতে মাছ, কাঁকড়া ধরা, বাগান চাষ করা ছাড়া বিকল্প কাজের ব্যবস্থা এখনও গড়ে তোলা যায়নি। হ্যামিল্টন সাহেবের বিশাল কর্মকাণ্ড যে আকার নেওয়ার কথা ছিল, তার প্রায় কিছুই দেখা যায় না গোসাবায়। এমনকী, প্রাকৃতিক শোভার জন্য প্রসিদ্ধ সুন্দরবনের এই অংশে পর্যটনেও খামতি থেকে গিয়েছে।

(চলবে)

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE