Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রাজনীতির কথা কেন, শিক্ষককে শাস্তি তৃণমূলের

প্রজাতন্ত্র দিবসে স্কুলে জাতীয় পতাকা তোলার পরে ‘দু’কথা’ বলতে গিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতির কথা টেনে এনেছিলেন এক স্কুল শিক্ষক। কাকদ্বীপের শিবকালীনগর ঈশান মেমোরিয়াল হাইস্কুলের ইংরাজির শিক্ষক গৌতম মণ্ডলের সেই ‘মন্তব্যে’ রাজনীতির ছায়া দেখে অনুষ্ঠানের মধ্যেই তাঁকে বেধড়ক মারধর কর শাসক দলের সমর্থকেরা। অভিযোগ, সোমবারের ওই শিক্ষক-নিগ্রহের ওই ঘটনায়, দাঁড়িয়ে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা শুভ্রাংশু কামার।

প্রহৃত শিক্ষক গৌতম মণ্ডল।—নিজস্ব চিত্র।

প্রহৃত শিক্ষক গৌতম মণ্ডল।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কাকদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০১
Share: Save:

প্রজাতন্ত্র দিবসে স্কুলে জাতীয় পতাকা তোলার পরে ‘দু’কথা’ বলতে গিয়ে সাম্প্রতিক রাজনীতির কথা টেনে এনেছিলেন এক স্কুল শিক্ষক।

কাকদ্বীপের শিবকালীনগর ঈশান মেমোরিয়াল হাইস্কুলের ইংরাজির শিক্ষক গৌতম মণ্ডলের সেই ‘মন্তব্যে’ রাজনীতির ছায়া দেখে অনুষ্ঠানের মধ্যেই তাঁকে বেধড়ক মারধর কর শাসক দলের সমর্থকেরা। অভিযোগ, সোমবারের ওই শিক্ষক-নিগ্রহের ওই ঘটনায়, দাঁড়িয়ে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা শুভ্রাংশু কামার।

রাজ্যে পালাবদলের পরে শিক্ষা ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। দীর্ঘ সেই তালিকায় নিছক একটি সংযোজন মাত্র।

অথচ, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির দাপাদাপি যে একেবারে পছন্দ নয় তাঁর, রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পরে মহাকরণে দাঁড়িয়েই এমনই বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

সে বার্তা তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কতটা প্রভাব ফেলছিল তা নিয়ে প্রশ্ন অবশ্য থেকেই গিয়েছিল। কারণ, ক্ষমতা দখলের দু’মাসের মধ্যেই টিএমসিপি-র সমর্থকদের হাতে প্রহৃত হয়ে মারা গিয়েছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষাকর্মী।

সেই শুরু। কখনও দলের ছাত্র সংগঠন কখনও বা দলের মাঝারি মাপের নেতা, এমনকী দলীয় বিধায়ক-কাউন্সিলরের হাতেও ক্রমান্বয়ে ঘটে চলা শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় ছেদ পড়েনি। অশোকনগর কিংবা গুমার স্কুলে প্রধান শিক্ষককে মারধর, রায়গঞ্জ কলেজে অধ্যক্ষকে কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে প্রহার, ভাঙড়ের কলেজে শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মারা কিংবা কলকাতার যাদবপুর বিদ্যাপীঠে চড়াও হয়ে প্রধান শিক্ষককে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর তপন দাশগুপ্তের সপাটে চড় মারার ঘটনাদীর্ঘ তালিকা।

এর খুব কাছাকাছি রয়েছে স্থানীয় বিধায়কের উপস্থিতিতে কলেজে ভাঙচুর কিংবা প্রাক্তন টিএমসিপি সভাপতি শঙ্কুদেব পন্ডার মদতে কলেজে হামলার ঘটনা।

তবে টিএমসিপি কিংবা দলীয় নেতা-কর্মীদের এই হামলার বিরুদ্ধে কখনও-ই কড়া কথা শোনা যায়নি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। বরং তাঁদের দোষ নিছকই ‘ছোট ছেলের ভুল’ বলে দায় এড়িয়ে যান তিনি। কাকদ্বীপের ওই ঘটনার পরেও স্বাভাবিক ভাবেই কোনও মন্তব্য আসেনি তাঁর কাছ থেকে।

কাকদ্বীপের ওই স্কুলে প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে স্কুলে জাতীয় পতাকা তোলার পরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে গৌতমবাবু রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দু’কথা বলে ফেলেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। তিনি বলেন, “আইন যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের মধ্যেই আইন ভাঙার প্রবণতা দেখা যায়।” স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, গৌতমবাবু বক্তব্য রেখে বসতে যাবেন, আচমকা তাঁকে ঘিরে ধরেন জনা আটেক তৃণমূল সমর্থক। কলার ধরে টেনে বের করে শুরু হয় মারধর। অভিযোগ, স্কুলের অনুষ্ঠানে কেন ‘রাজনৈতিক ভাষণ’ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি কোনও রাজনীতির কথা বলেননি। সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন মাত্র। কাউকে অসম্মানও করেননি। গৌতমবাবুর অভিযোগ, “ওরা কোনও কথা কানেই তুলতে চাইছিল না। শুধু বলছিল, রাজনীতির কথা কেন বলেছিস।” ওই শিক্ষকের দাবি, হামলার ঘটনায় সামনের সারিতে থেকে প্ররোচনা দিয়েছেন স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক বলে পরিচিত শুভ্রাংশু কামার ওরফে বাবুসোনা। বাবুসোনা অবশ্য দাবি করেছেন, মারধরের ঘটনার সময়ে তিনি স্কুলে হাজিরই ছিলেন না। তিনি বলেন, “আমি খবর শুনে স্কুলে এসে দেখি, জনতা ওই শিক্ষককে ঘিরে রেখেছে। স্কুলে রাজনীতির কথা বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল অনেকে।”

পুলিশ আসে, ওই শিক্ষককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। গৌতমবাবু বলেন, “আমি পুলিশকে বলতে থাকি, মার তো খেলাম আমি। আর আমাকেই থানায় আটকে রাখছেন!” শুধু ঘণ্টা চারেক থানায় আটক রাখাই নয়, তাঁর অভিযোগ, সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে সোজা বাস ধরে বাড়ি চলে যেতে বলা হয় তাঁকে। সেই মতোই হাসপাতালে না গিয়ে সোজা কাকদ্বীপেরই ধলেরখালে আত্মীয়ের বাড়িতে চলে আসেন তিনি। হাসপাতালে যাওয়ারও সাহস পাননি। গৌতমবাবুর কথায়, “ভয়ে কাউকে কিছু জানাতে পারিনি। তৃণমূলের লোকজন নানা ভাবে হুমকি দিচ্ছিল।”

স্থানীয় বিধায়ক তথা সুন্দরবন উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা বলেন, “আমি এলাকায় ছিলাম না। তবে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, প্রজাতন্ত্র দিবসের মতো বিশেষ দিনে এক জন শিক্ষক যে ভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন, তা মেনে নিতে পারেননি এলাকার অনেকে।” তার জেরেই শাস্তি? মন্টুরামবাবুর মুখে উত্তর মেলেনি।

তবে বুধবার, সাহস করে কাকদ্বীপ থানাতে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন গৌতমবাবু। এ বার অবশ্য পুলিশ অভিযোগ নিয়েছে। তারপর?

গৌতমবাবুর আশঙ্কা, “অভিযোগ তো করলাম কিন্তু, এর পরে আর স্কুলে যেতে পারব কি?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE