Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দুঃস্বপ্নের রাত বদলে দিল চেনা পাহাড়ের ছবি, ধসে মৃত ৩০

দুপুর থেকে তুমুল বৃষ্টিতে মঙ্গলবার অসময়েই সন্ধে নেমেছিল দার্জিলিং পাহাড়ে। মিরিকের সৌরিনি, টিংলিং এলাকার মানুষ রাতে যখন শুতে গিয়েছিলেন, জানতেনও না কী দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁদের জন্য। প্রবল ধসে রাতের মধ্যেই বদলে গেল পাহাড়ের চেনা চেহারা। ঘরদোর চাপা পড়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন মিরিক, কালিম্পং-সহ লাগোয়া কয়েকটি এলাকার অন্তত ৩০ জন।

মিরিকের টিংলিংয়ে ধসে মৃত বাসিন্দার দেহ উদ্ধার করা হচ্ছে। — নিজস্ব চিত্র।

মিরিকের টিংলিংয়ে ধসে মৃত বাসিন্দার দেহ উদ্ধার করা হচ্ছে। — নিজস্ব চিত্র।

অনির্বাণ রায় ও রেজা প্রধান
মিরিক শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪৯
Share: Save:

দুপুর থেকে তুমুল বৃষ্টিতে মঙ্গলবার অসময়েই সন্ধে নেমেছিল দার্জিলিং পাহাড়ে। মিরিকের সৌরিনি, টিংলিং এলাকার মানুষ রাতে যখন শুতে গিয়েছিলেন, জানতেনও না কী দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁদের জন্য। প্রবল ধসে রাতের মধ্যেই বদলে গেল পাহাড়ের চেনা চেহারা। ঘরদোর চাপা পড়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন মিরিক, কালিম্পং-সহ লাগোয়া কয়েকটি এলাকার অন্তত ৩০ জন। প্রশাসন সূত্রের খবর, মৃতদের মধ্যে ২১ জন মিরিকের ও ৮ জন কালিম্পঙের। এক জনের দেহ পাওয়া গিয়েছে সুখিয়াপোখরিতে। নিখোঁজ ১১ জন। বৃষ্টিতে উদ্ধারের কাজে কিছুটা বিঘ্নও ঘটেছে। কিন্তু পাহাড়বাসীর সব থেকে বড় ক্ষোভ, ভরা বর্ষায় ধস নামে জানা থাকা সত্ত্বেও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী কেন সে ভাবে প্রস্তুত ছিল না?

ঘটনা কতটা ভয়াবহ তার আঁচ পেতেই কেটে যায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি ঘণ্টা। রাজ্য সরকারের যখন টনক নড়ে, তত ক্ষণে বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। তাতেও পর্যাপ্ত উদ্ধারকারী বাহিনী পায়নি প্রশাসন। কেন্দ্রের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর যোগাযোগের পরে ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স-এর (এনডিআরএফ) দল কাজে নামে। তখন উদ্ধারে গতি বাড়ে। সকালে তাঁদের একটি দল উদ্ধার কাজে নেমে পড়েছিল। বিকেলে আর একটি দল পাহাড়ে পৌঁছয়। পরে সশস্ত্র সীমা বলের দুই প্লাটুন জওয়ানও উদ্ধারে হাত লাগিয়েছেন।

এর মধ্যে প্রশাসনের শীর্ষ স্তরেও নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। দুপুরে বীরভূমের প্রশাসনিক বৈঠক বাতিল করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদ থেকেই দার্জিলিঙের দিকে রওনা হন। পরে তিনি বলেন, ‘‘আমরা সব শক্তি দিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজ করছি। নিখোঁজ সকলকে খুঁজে বার করতে হবে।’’ মুখ্যমন্ত্রী আসার আগেই বাগডোগরায় পৌঁছে যান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু। বিকেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করে সে কথা জানিয়েও দেন।

আর তাতেই ক্ষুব্ধ মমতা। রাতে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে দাঁড়িয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘উনি (রিজিজু) আসার আগে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। শুধু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল। তা করে দিয়েছি।’’ পরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানানো হয়, তিনি যখন মুর্শিদাবাদে প্রশাসনিক বৈঠক করছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের দফতর থেকে ফোন আসে। অনুষ্ঠান শেষে সেই ‘মিসড কল’ দেখে মমতা ফিরে ফোন করেন। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে বলা হয়, রাজনাথ এখন পথে। পরে তিনি ফোন করে নেবেন। কিন্তু রাত পর্যন্ত সেই ফোন আসেনি বলে মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি।

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেন। পরিস্থিতি নিয়ে সবিস্তার কথা হয়। বুধবার সুকনায় রাত কাটাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার তিনি সকাল সকাল মিরিক যাবেন বলেই রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর। অন্য দিকে, রিজিজুও বৃহস্পতিবার সকালে পাহাড়ে যাবেন।

প্রশাসনিক সূত্রে বলা হচ্ছে, পাহাড়কে বারবরই মুখ্যমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। বড় বিপর্যয় হলে তিনি সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু তাঁর আগেই এ দিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান মোর্চা নেতা বিমল গুরুঙ্গ। পরে তিনি নিজেরফেসবুক পেজ-এ ত্রাণের ঘোষণাও করে দেন— মৃতদের পরিবারের জন্য ২ লক্ষ এবং গুরুতর জখমদের ৫০ হাজার টাকা করে। সকালে গুরুঙ্গ ফিরে আসার পরে মিরিকে যান সুবাস ঘিসিঙ্গের ছেলে মন ঘিসিঙ্গও। বিকেলে শিলিগুড়ি পৌঁছন রিজিজু। তত ক্ষণে মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।

তৃণমূল এবং রাজ্য প্রশাসনের একাংশের তরফে বলা হচ্ছে, রাজ্যকে না জানিয়ে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আগমনই মমতার ‘ধৈর্যচ্যুতি’ ঘটিয়েছে। তিনি যে মৃতদের পরিবারের জন্য ৪ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন, সেটাও সকলের পরে। একমাত্র উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব কিছুটা হলেও মান রেখেছেন রাজ্যের। তিনি অন্য কাজ ফেলে রেখে পাহাড়ে ছুটে যান।

রিজিজুর সঙ্গে বাগডোগরায় এসেছেন দার্জিলিঙের সাংসদ এসএস অহলুওয়ালিয়া। মমতার ক্ষোভের কথা শুনে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘রিজিজু সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী। তা হলে তিনি কেন ঘটনাস্থলে যাবেন না?’’

একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে— যেখানে পাহাড়ে এমন টালমাটাল অবস্থা, ধসের জায়গায় অনেকে এখনও নিখোঁজ, সেখানে ভিভিআইপি-রা দল বেঁধে গেলে কাজে অসুবিধা হবে না কি? প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গেলে লম্বা গাড়ির লাইন পড়ে। তাঁরা দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেন। ফলে সব মিলিয়ে এক এক জনের তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টা তো লেগেই যায়। পাহাড়ে তৃণমূল নেতা বিন্নি শর্মা অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সফরের জন্য আলাদা কোনও ব্যবস্থা করতে হয় না।’’

এমনিতেই আগাম সতর্কতা নেওয়া হয়নি দেখে পাহাড়বাসী ক্ষুব্ধ। ক্ষতিপূরণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যেই তাঁদের প্রশ্ন, আগে থেকে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? জিটিএ-র তরফ থেকে মাঝেমধ্যেই দাবি করা হয়, পাহাড়ে নির্মাণ-সহ নানা বিধিনিষেধের বিষয়ে পুরসভাগুলি উদ্যোগী হয়েছে। বুধবার দুপুরে ধস-বিধ্বস্ত টিংলিংয়ের লিম্বুগাঁওয়ের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, শুধু সমীক্ষা বা বৈঠকের গালভরা সিদ্ধান্তের কথা শোনা গেলেও, কেউ কোনও পদক্ষেপ করেনি। সময়মতো পদক্ষেপ নিলে ধস রোখা সম্ভব ছিল বলে বাসিন্দাদের দাবি। সেই সঙ্গে রাজ্য সরকার এবং জিটিএ দু’পক্ষই পাহাড়ের নির্মাণে বিধিনিষেধের কথা বললেও, পাহাড় জুড়ে পাকদণ্ডি রাস্তার পাশ দিয়ে খোঁড়াখুড়ি চলছেই বলে অভিযোগ।

এ দিন ধস কবলিত টিংলিং এলাকায় গিয়েছিলেন গৌতম দেব। তিনি অবশ্য বলেন, ‘‘সমীক্ষার কাজ একটা চলছে। তার সব রিপোর্ট এখনও আসেনি। কিছু পদক্ষেপ হয়েছে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘টিংলিংয়ের মতো প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে ধস নামলে কিছু করার থাকে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আঘাত অনেক তীব্র হয়। তবে দ্রুত সমীক্ষা শেষ করে পদক্ষেপ হবে।’’

কতটা তীব্র ভাবে এ দিন পাহাড়ে আঘাত এসেছে, সেটা বোঝা যায় সৌরিন, টিংলিং এবং মিরিক এলাকায় পৌঁছলে। পুলিশ এবং প্রশাসন সূত্রের খবর, ধসে মৃতদের মধ্যে ২০ জন মিরিকের সৌরিনি ও টিংলিং চা বাগান এলাকার। বাকিদের মধ্যে কালিম্পং, সুখিয়াপোখরি, গরুবাথান এবং আলগাড়ার লোক। এই জায়গাগুলির কোথাও পাহাড়ি বস্তি ধসে গিয়ে, কোথাও বাড়িঘরের উপর মাটি, কাদা, পাথর চাপা পড়েই বাসিন্দাদের মৃত্যু হয়েছে।

পাহাড়ের মিরিক ব্লকেই সব চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি এবং মৃত্যু হয়েছে। এ দিন দুপুরেই এলাকায় প্রথম যান জিটিএ প্রধান বিমল গুরুঙ্গ। তিনি এলাকাটি ঘুরে দেখে বাসিন্দাদের সমবেদনা জানান। মৃতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘‘উদ্ধার কাজ চলছে। পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে জিটিএ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় তত্ত্বাবধান করছেন।’’

তবে উদ্ধার কাজ সকালের দিকে ঢিলেঢালা ভাবে চলছিল বলে অভিযোগ। সকালে রাজ্য সরকারের সিভিল ডিফেন্সের কর্মীদের উদ্ধার কাজে নামানো হয়। জেলার ব্লক ধরে ধরে ২৫ জনের দলগুলিকে দিয়ে এই বিশাল বিপর্যয় রোখার কাজ কতটা করা যাবে, তা নিয়ে আধিকারিকদের মধ্যেই আলোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে এই ধরনের দুর্যোগের মোকাবিলা করতে প্রশিক্ষিত হতে হয়, থাকতে হয় আধুনিক সরঞ্জামও। যা সরকারি সিভিল ডিফেন্সের দলগুলির কাছে খুব একটা থাকে না। বিশেষ করে উঁচু পাহাড়ি এলাকা, নদী, বন্যার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারা কর্মীদের দরকার হয়ে পড়ে।

টিংলিংয়ের এক বাসিন্দা জানান, ‘‘উদ্ধারকারী দল দেরিতে এসে পৌঁছেছে। বর্ষায় পাহাড়ের জনবসতির কাছাকাছি এমন দলগুলি রাখা দরকার। তা হয়নি কেন, তার জবাব কে দেবে?’’

অবশ্য পাহাড় শুধু নয়, টানা বর্ষণের ফলে তিস্তা-সহ উত্তরবঙ্গের সব নদী ফুঁসছে। পাহাড় লাগোয়া ডুয়ার্সের বহু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। জলপাইগুড়িতে তিস্তায় লাল সঙ্কেত জারি হয়েছে। অন্তত ২৫ হাজার বাসিন্দা জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। গজলডোবা এলাকায় রাস্তা ডুবে গিয়েছে। সেবকেও মংপংয়ের কাছে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে ধসে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE