শিশুদের কান্নায় বিশপুরিয়া গ্রামে উপস্থিত প্রায় সকলেই আবেগে ভেসে যান। —নিজস্ব চিত্র।
মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই ভিটেমাটি ছেড়ে শেলটার হোমে যেতে হল একই পরিবারের এক শিশু এবং তিন নাবালককে। তাদের বিদায় জানাতে গিয়ে চোখের জলে ভাসলেন গ্রামবাসীরা। কান্না চেপে রাখতে পারলেন না ওই নাবালকদের হোমে নিতে আসা চাইল্ড লাইনের কর্মী থেকে পুলিশ আধিকারিকেরাও। শনিবার এমন আবেগবিহ্বল দৃশ্যের সাক্ষী থাকল পুরুলিয়া জেলার হুড়ার বিশপুরিয়া।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তিন বছরের কবিতা, বছর চারেকের ছবিতা, ছ’বছরের অনিতা এবং ১৮ মাসের বুদ্ধেশ্বরের বাবা মটক সিংহ সর্দার দীর্ঘদিন ধরে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। মাস চারেক আগে মারা যান তিনি। চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনও ক্রমে সংসার চালাচ্ছিলেন তাদের মা লক্ষ্মী সিংহ সর্দার। অভিযোগ, পঞ্চায়েতের কাছে বহু বার আবেদন করেও সরকারি সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন তিনি। বাড়ি জোটেনি বলে অর্ধসমাপ্ত পাঁচিলের উপর এক টুকরো ত্রিপল খাটিয়ে থাকতেন লক্ষ্মী। দিন কয়েক আগে মারা যান লক্ষ্মীও। অনাথ হয়ে যায় তাঁর চার সন্তান। ত্রিপলের তলাতেই দিন কাটছিল তাদের। অভিযোগ, বিজেপি পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েত সমিতি— সর্বত্র সাহায্যের আবেদন করলেও কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।
সম্প্রতি ওই শিশুদের দুর্দশার কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন এলাকার এক তৃণমূল নেতা। এর পর ওই গ্রামে গিয়ে অনাথ শিশুদের আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি রেশন সামগ্রী ও জামাকাপড় তুলে দেন পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁর কাছে আবেদন করেন যাতে ওই শিশুদের কোনও হোমে পাঠানোর বন্দোবস্তা করা যায়। জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন সভাধিপতি।
রবিবার বিশপুরিয়া গ্রামে চাইল্ড লাইনের জেলার প্রতিনিধি এবং হুড়া থানার পুলিশ আধিকারিকেরা পৌঁছন। সে সময় সবেমাত্র শ্রাদ্ধের আচার সেরে উঠেছে অনিতারা। তাদের অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে জানতে পেরে কাঁদতে শুরু করে বুদ্ধেশ্বরের দিদিরা। বাড়ি ছেড়ে যাবে না বলে বার বার বলতে থাকে তারা। চাইল্ড লাইনের আধিকারিক মহিলাকে জড়িয়ে ধরে ‘মা মা’ বলে কাঁদতে শুরু করে ছোট্ট বুদ্ধেশ্বর। খবর পেয়ে গ্রামের বাসিন্দারা ছাড়াও আশপাশের এলাকা থেকে মানুষের ভিড় জমে ওঠে। শিশুদের কান্নায় সেখানে উপস্থিত প্রায় সকলেই আবেগে ভেসে যান। অবশেষে চাইল্ড লাইন এবং পুলিশ আধিকারিকেরা বুঝিয়েসুজিয়ে তাদের সেখান থেকে হোমে যেতে রাজি করান।
ভিটে ছেড়ে যাওয়ার সময়ও ছবিটা-কবিতা প্রশ্ন করতে থাকে, “মায়ের কাছে তাদের কখন নিয়ে যাওয়া হবে?” এর পর কাঁদতে কাঁদতেই গাড়িতে বসে তারা। শিশুদের এই আকুতি দেখে চোখের জল চেপে রাখতে পারেননি গ্রামের ছোট-বড়— অনেকেই। চোখ ছলছল চাইল্ড লাইনের কর্মী-আধিকারিকদেরও। তবে তার মধ্যেই ওই চার শিশুকে সেখান থেকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও তাদের দেখে চোখ ছল ছল হুড়া থানার আধিকারিক বিশ্বজিৎ মণ্ডলের।
পুলিশ সূত্রে খবর, শনিবার অনিতা, ছবিটা এবং কবিতাকে মেদিনীপুরের একটি হোমে পাঠানো হয়েছে। শিশু বুদ্ধেশ্বরেরকে আদ্রার মণিপুর হোমে পাঠানো হয়। গ্রামের প্রায় সকলেরই চাইছেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গ্রামে ফিরে আসুক চার জনই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy