Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ফের পাশ লগ্নি সংস্থা বিল, প্রশ্ন সদিচ্ছা নিয়েই

বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণে ১২ বছরে ছ’বার পাশ হল বিল! কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বারও সেই বিলটি আইনে রূপান্তরিত হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেল। সরকারপক্ষের দাবি, রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়ার জন্য কেন্দ্রের দেওয়া সব শর্তই নতুন বিলে রাখা হয়েছে। ফলে, আইনে রূপান্তরিত হওয়াটা সময়ের অপেক্ষা। আবার বিরোধীপক্ষের দাবি, বারবার রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানোর পরে দিল্লি থেকে ফিরে এসেছে বিলটি। ফলে, চূড়ান্ত সম্মতি দিয়ে রাষ্ট্রপতির বার্তা না আসা পর্যন্ত বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণে রাজ্যকে ঠুঁটো হয়েই থাকতে হবে। এ নিয়ে রাজ্যকে বিঁধতেও ছাড়েননি বিরোধীরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৫ ০৩:৫৮
Share: Save:

বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণে ১২ বছরে ছ’বার পাশ হল বিল! কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বারও সেই বিলটি আইনে রূপান্তরিত হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেল। সরকারপক্ষের দাবি, রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়ার জন্য কেন্দ্রের দেওয়া সব শর্তই নতুন বিলে রাখা হয়েছে। ফলে, আইনে রূপান্তরিত হওয়াটা সময়ের অপেক্ষা। আবার বিরোধীপক্ষের দাবি, বারবার রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানোর পরে দিল্লি থেকে ফিরে এসেছে বিলটি। ফলে, চূড়ান্ত সম্মতি দিয়ে রাষ্ট্রপতির বার্তা না আসা পর্যন্ত বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণে রাজ্যকে ঠুঁটো হয়েই থাকতে হবে। এ নিয়ে রাজ্যকে বিঁধতেও ছাড়েননি বিরোধীরা।

‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অফ ইন্টারেস্ট অব ডিপোজিটরস ইন ফিনান্সিয়াল এসটাব্লিশমেন্ট’ বিলটি বিধানসভায় প্রথম পেশ হয় ২০০৩ সালে। রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হলে কেন্দ্র তাতে সম্মতি দিতে অস্বীকার করে। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বৃহস্পতিবার বিধানসভায় জানান, ২০০৬-এর ৫ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তৎকালীন যুগ্মসচিব পি কে শেঠ রাজ্যের তদানীন্তন অর্থসচিব সমর ঘোষকে চিঠিতে জানান, রাজ্য সরকারের বিলটি ভুল এবং অসম্পূর্ণ হওয়ায় তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হচ্ছে না। এর পরে ২০০৮ সালের ১৮ মার্চ বামফ্রন্ট সরকার বিধানসভায় এ সংক্রান্ত একটি নতুন বিল পেশ করে। কিন্তু আরও আলোচনার জন্য সে সময় বিলটিকে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ৩০ জুলাই পুরনো আইনটি কেন্দ্র রাজ্যের কাছে ফেরত পাঠায়। তখন ২০০৮-এর পেশ হওয়া আইনটি ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি ফের বিধানসভায় এনে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠায় বামফ্রন্ট সরকার।

ঘটনাচক্রে এই সময় থেকেই রাজ্যে বেআইনি লগ্নি সংস্থার রমরমা শুরু। সারদা, রোজভ্যালি, এমপিএস, প্রয়াগ, ফরচুন, আইকোর-এর মতো প্রায় ৭৪টি সংস্থা বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলেছে বলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অভিযোগ জমা পড়ে। টাকা ফেরত না পেয়ে বিক্ষোভ দেখান আমানতকারীরা। ২০১২-এর ডিসেম্বরে রাজ্য বিধানসভায় বিরোধীরা আলোচনা চাইলে সরকারপক্ষের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হয়। মারামারিতে দু’জন বাম বিধায়ক আহত হন। এর পরে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশ্যে আসে সারদা কেলেঙ্কারি। বিপুল অর্থ নয়ছয় করে উধাও হন সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। এ নিয়ে হইচইয়ের মধ্যেই প্রকাশ্যে আসে তাঁর সঙ্গে শাসক দলের একাধিক নেতার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি। বিরোধীরা বিষয়টি নিয়ে সরব হয়। এই পরিস্থিতিতে ২০১৩-র ২৯ ও ৩০ এপ্রিল বিধানসভায় বিশেষ অধিবেশন ডেকে বাম জমানার পাঠানো বিলটি ফেরত এনে এই সংক্রান্ত আরও একটি নতুন বিল পেশ করে তৃণমূল সরকার।

কিন্তু সেই বিল নিয়েও প্রশ্ন তোলে কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রক। বিভিন্ন মন্ত্রকের তোলা পর্যবেক্ষণ সংযুক্ত করে ওই বছরেরই ডিসেম্বরে ফের বিলটি বিধানসভায় পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। সেই বিলের উপরেও কেন্দ্রীয় সরকার ছ’টি সংশোধনী যোগ করতে বলে। ওই সব সংশোধনী যোগ করার শর্তেই রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়া যাবে বলে ২৫ মার্চ রাজ্যকে জানিয়ে দেয় কেন্দ্র।

কেন্দ্র যে ছ’টি শর্ত দিয়েছিল, তার মধ্যে পাঁচটি রাজ্য মেনে নিয়েছে। আগে বলা ছিল, এই সংক্রান্ত মামলায় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ তদন্ত শেষে মামলার অনুমোদন দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু তারা সেই অনুমোদন দিতে পারে, না-ও পারে। আগে এই অনুমোদন দেওয়ার জন্য কোনও সময়সীমা নির্দিষ্ট করা ছিল না। এখন বলা হল, অনুমোদন দিতে গেলে ছ’মাসের মধ্যে দিতে হবে। আগে বলা ছিল বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার শুধু অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে। সংশোধনীর পরে এখন থেকে অর্থ-সম্পত্তি-সহ যে কোনও ধরনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যাবে। এ ছাড়াও, বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি নিলামের জন্য বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন এবং এই সংক্রান্ত মামলায় অন্য আইনের সঙ্গে এই আইনের যোগের বিষয়টিতেও বদল হয়েছে। তবে কেন্দ্র প্রস্তাব দিয়েছিল, জরিমানা দিয়ে কারাদণ্ড মকুবের বিষয়টি নতুন আইনে রাখা হোক। কিন্তু তাতে শাস্তি লঘু হয়ে যাবে এই যুক্তিতে রাজ্য আপত্তি তোলে। কেন্দ্র শেষ পর্যন্ত রাজ্যের আপত্তি মেনে নিয়েছে।

এ দিন বিধানসভার বিতর্কে অংশ নিয়ে আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, সরকারপক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, বাম আমলে রমরমা শুরু হলেও তারা কোনও বেআইনি লগ্নি সংস্থার মালিককে জেলে পুরতে পারেননি। আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারেনি। বর্তমান সরকারই সারদার নায়ক সুদীপ্ত সেন-সহ অনেককেই জেলে পুরেছে। আমানতকারীদের জন্য টাকা ফেরতের জন্য পাঁচশো কোটি টাকার তহবিল গড়েছে। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘রাজ্যে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার মদতদাতা হিসেবে সিপিএম যদি পিতা হয়, তা হলে বর্তমান শাসক দল মাতা! কেন বারবার প্রধানমন্ত্রীর দফতর সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে জানতে চাইলেও রাজ্য চুপ থেকেছে। মে মাসেও সিবিআই চিঠি দিয়ে
সারদা সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে রাজ্যের কাছে। তা-ও রাজ্য চুপ!’’ প্রস্তাবিত আইনে আবার তদন্ত শেষে অভিযুক্ত সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা চালানোর অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা রাজ্য নিজের হাতে রাখা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

কংগ্রেস বিধায়ক মহম্মদ শোহরাব বলেন, ‘‘এই বিল প্রথম বার পেশ করে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই আইন কার্যকর করা হবে। কিন্তু তার বদলে দু’বছর কেটে গিয়েছে!’’ বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘একটা হচ্ছে আইন।
আর একটা সদিচ্ছা। আমরা আইন করিনি। কিন্তু সদিচ্ছার অভাব ছিল না।’’ এই প্রসঙ্গেই তিনি জানান, বাম আমলে কোনও আইন ছাড়াই চিটফান্ডের সঙ্গে যুক্ত একশো জনের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয এবং আদালতের সাহায্য নিয়ে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। বিরোধী দলনেতার কটাক্ষ, ‘‘শ্যামল সেন কমিশনের রিপোর্ট এখনও পর্যন্ত বিধানসভায় পেশ করা হল
না কেন? যাঁরা টাকা চুরি করলেন, তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হল না। অথচ, যাঁদের টাকা লুঠ হল, তাঁদেরই দেওয়া করের টাকায় ক্ষতিপূরণ দিলেন।’’ ফরওয়ার্ড ব্লকের উদয়ন গুহ সরকারকে বিঁধে বলেন, ‘‘আমরা বলি, আইন আইনের পথে চলবে। কিন্তু আইন যদি পিজি হাসপাতালে গিয়ে শুয়ে পড়ে, তা হলেই মুশকিল!’’ পাশাপাশি বিজেপিকেও বিঁধতে ছাড়েননি তিনি। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের উদ্দেশে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘প্রধানমন্ত্রী এক বছরে ১৮ বার বিদেশ গিয়েছেন। এই বিশ্বপথিককে প্রশ্ন, আপনার সিবিআই কি পথ হারাইয়াছে?’’

জবাবে অমিত মিত্র বলেন, ‘‘এই সরকারই অভিযুক্ত সংস্থার অফিসে ঢোকা, তল্লাশি চালানো, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, তা নিলাম করে, বিক্রি করে আমানতকারীদের টাকা ফেরানোর ব্যবস্থা করেছে। অভিযুক্তদের যাবজ্জীবন জেলেরও ব্যবস্থা রয়েছে আইনে।’’ নতুন বিল পেশ করে অর্থমন্ত্রীর দাবি, যে হেতু কেন্দ্রের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই সংশোধনীগুলি আনা হয়েছে। তাই, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির সম্মতি মিলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE