Advertisement
E-Paper

মুখ খুললেই মরবে, বলছেন স্বজনহারারা

“প্রতিবাদ করলেই খুন হতে হবে।” সোমবার এই তালিকায় আর একটি নাম সংযোজন হওয়ার পরে এমনই মনে করছেন রাজীবের দিদি রিঙ্কু দাস। মনে করছেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন তো হয়ইনি। বরং দিনে-দিনে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’। কলকাতার কর্মস্থল থেকে রাতে বাড়ি ফিরছিলেন রিঙ্কু দাস। সাইকেল নিয়ে দিদিকে বাড়ি নিয়ে যেতে বারাসত স্টেশনে এসেছিল ভাই, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১০

রাজীব দাস

“প্রতিবাদ করলেই খুন হতে হবে।” সোমবার এই তালিকায় আর একটি নাম সংযোজন হওয়ার পরে এমনই মনে করছেন রাজীবের দিদি রিঙ্কু দাস। মনে করছেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন তো হয়ইনি। বরং দিনে-দিনে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।

২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’। কলকাতার কর্মস্থল থেকে রাতে বাড়ি ফিরছিলেন রিঙ্কু দাস। সাইকেল নিয়ে দিদিকে বাড়ি নিয়ে যেতে বারাসত স্টেশনে এসেছিল ভাই, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব। পথেই মদ্যপ তিন যুবক অসভ্যতা করে রিঙ্কুর সঙ্গে। প্রতিবাদ করায় রিঙ্কুর সামনেই ছুরি দিয়ে কুপিয়ে রাজীবকে খুন করে দুষ্কৃৃতীরা। জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের বাংলোর কাছেই। প্রশাসনিক কর্তাদের দরজা নেড়েও সুবিচার মেলেনি। সোমবার রিঙ্কু বললেন, “সে দিন যে সুবিচারের জন্য পাগলের মতো দৌড়ে বেরিয়েছিলাম, তা আজও পাইনি। আমার ভাইয়ের হত্যাকারীরা শাস্তি পায়নি।” ওই ঘটনা নিয়ে পরে রাজ্যজুড়ে শোরগোল হয়। ৩ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে চার্জশিট দেয় সিআইডি। বারাসত আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হলেও এখনও সাজা ঘোষণা হয়নি। বারাসতের জেলা আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (যিনি রাজীব হত্যাকাণ্ড মামলার বিশেষ সরকারি কৌঁসুলিও) শান্তময় বসু অবশ্য এ দিন বলেন, “কখনও বিচারক বদল, কখনও সাক্ষ্যগ্রহণে সমস্যার জন্যই এই দেরি। শীঘ্রই রায় হয়ে যাবে।”

এর পর থেকে বিশেষ কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে বার হন না রিঙ্কু। তাঁর বক্তব্য, “চার বছর পেরিয়ে গেল, রায় ঘোষণাই হল না। তার মানে সরকার চাইছে, প্রতিবাদী, আক্রান্তরা ঘরে বসে থাকুন। আর অপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াক। আজকে যিনি মারা গেলেন, তাঁর খুনি কবে ধরা পড়বে? কত বছর পরে তার সাজা হবে, তা কি কেউ জানেন?”

এ দিন সকালেই অরূপের মৃত্যুর ঘটনা জানতে পেরেছেন রিঙ্কু। বললেন, “যে পরিবারের কেউ চলে যায়, তারাই শুধু বোঝে সে যন্ত্রণা কতটা। আমার ভাইয়ের মতোই এই মানুষটিকেও নৃশংস ভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। ভাই চলে যাওয়ার পরে আমাদের গোটা পরিবারটা ছারখার হয়ে গেল।” রিঙ্কু বলেন, “দেশে আইন নেই বলেই সমাজবিরোধীদের সাহস বেড়ে চলেছে। একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই চলেছে। থামার কোনও নামই নেই।” রিঙ্কুর প্রশ্ন, “এর পর তো রাস্তাঘাটে কোনও অন্যায় হলে সবাই পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। সরকার কত দিন আর মুখ বন্ধ করে থাকবে?”

বরুণ বিশ্বাস

তাঁর জীবন নিয়ে সিনেমা হয়েছে। শিক্ষক বরুণ বিশ্বাসের প্রতিবাদ এখনও প্রেরণা জোগায় বহু মানুষকে। কিন্তু আজও আতঙ্কে তাঁর পরিবার। সোমবার সকালবেলা ঘুম থেকেই উঠেই সালকিয়ার ঘটনাটি জেনেছেন বরুণের দাদা অসিত বিশ্বাস। তিনি বললেন, “কাকদ্বীপে যে শিক্ষককে পেটানো হয়েছে, কাল তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। সকালেই শুনলাম মৃত্যুর খবর। প্রতিবাদ করলেই খুনের ঘটনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। অথচ সরকারের কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই!”

দু’হাজার সালের গোড়া থেকে গাইঘাটার সুটিয়ায় একের পর এক মহিলাদের উপর নারকীয় অত্যাচার চলছিল। প্রতিবাদ করলেই মারধর। একের পর এক গণধর্ষণের প্রতিবাদে নেমেছিলেন তরুণ শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়ে তৈরি করেছিলেন মঞ্চ। পুলিশে অভিযোগ জানিয়ে দুষ্কৃতীদের শাস্তির দাবিতে সরব হয়েছিলেন। সেই ‘অপরাধে’ ২০১২ সালের ৫ জুলাই বরুণকে গোবরডাঙা স্টেশনে গুলি করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। সেই ঘটনার বিচার এখনও চলছে বনগাঁ আদালতে। সেই মামলা প্রসঙ্গে এ দিন অসিতবাবু বলেন, “এখনও মূল অপরাধী বলাই মালাকার ধরাই পড়েনি। বিচারক না থাকায় বনগাঁ আদালতে মামলার দিন পিছিয়েই যাচ্ছে। ভাইয়ের খুনের রহস্যের কিনারাই হল না।”

সরকারের উদাসীনতায় একের পর এক অপরাধের ঘটনা ঘটছে বলে দাবি অসিতবাবুর। প্রতিবাদ করলেই মারধরের প্রবণতা মানুষকে আতঙ্কিত করছে বলে মনে করেন তিনি। অসিতবাবুর কথায়, “প্রতিদিন আতঙ্কে থাকি, আজ আবার কার মৃত্যুর কথা শুনব।” তবে তিনি এ-ও বললেন, “এ ভাবে বরুণদের মেরে ফেলা যায় না।”

সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

আমিনুল ইসলাম

অন্যায়ের প্রতিবাদ করে দুষ্কৃতীদের হাতে যে এক জন যুবক ফের মার খেয়েছেন, তা জানতেন। কিন্তু সোমবার সকালে যে সেই প্রতিবাদী যুবকের মৃত্যু হয়েছে, তা জানা ছিল না আমিনুলের মা শাহানাজ ইজাহারের। দুপুরে ছোট ছেলে আনোয়ারের কাছ থেকে খবরটা শুনে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “প্রতিবাদ করেছে, মারা তো যাবেই!”

অরূপের খবরটা শোনার পর থেকেই শাহানাজের চোখের সামনে ভেসে উঠছিল দু’বছর আগের ছবিটা।

দু’বছর আগে এলাকার এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁর বড় ছেলে আমিনুল। অভিযোগ ছিল কড়েয়া থানার পুলিশের ঘনিষ্ঠ এক জনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, সেই কারণেই পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা দূরে থাক, উল্টে আমিনুলের নামেই ডাকাতির অভিযোগ আনে। আমিনুলের পরিবারের অভিযোগ, দিনের পর দিন পুলিশি হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত কড়েয়া থানার সামনে গিয়ে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন আমিনুল। এক মাস পরে তাঁর মৃত্যু হয়।

ছেলের মৃত্যু যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা তিনি ভালই জানেন। “অরূপও আমার ছেলের মতো। ওর মায়ের এখন কী মানসিক অবস্থা, আমি বুঝি,” জানালেন আমিনুলের মা। মায়ের পাশেই বসে ছিল আনোয়ার। রাজ্য প্রশাসনের উপর একরাশ ক্ষোভ রয়েছে তাঁরও।

আনোয়ার জানালেন, দু’মিনিট দূরেই রিজওয়ানুরের দাদা রুকবানুরের বাড়ি। প্রতি বছরই ঈদ বা অন্যান্য উৎসবের সময়ে মুখ্যমন্ত্রী সেখানে আসেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এক দিনও তিনি তাঁদের বাড়িতে আসেননি। কখনও যোগাযোগ করেননি ফোনেও। উল্টে রাজ্য প্রশাসনের উপর ভরসা হারিয়ে সিবিআই তদন্তের জন্য যে মামলা করেছেন তাঁরা, সেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক মহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে আনোয়ার ও তাঁর মায়ের অভিযোগ।

সৌরভ চৌধুরী

অরূপ ভাণ্ডারীর উপরে আক্রমণের ঘটনার পর থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন দত্তপুকুরের বামনগাছির সন্দীপ চৌধুরী। এ দিন সকালে মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই চুপ করে বসে আসছেন। বললেন, “নতুন সরকার অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, যে কোনও ঘটনাকে লঘু করে দেখাতে চাইছে বলেই প্রতিদিন অপরাধ বাড়ছে। তবে এ সব নিয়ে এই সরকারের যে হেলদোল নেই আর একটি মৃত্যুই তার প্রমাণ।”

এলাকায় সমাজবিরোধী কাজকর্মের প্রতিবাদ করায় গত বছরের ৫ জুলাই দত্তপুকুরের বামনগাছিতে টুকরো টুকরো করে রেললাইনের পাশে ফেলে দেওয়া হয় কলেজ ছাত্র সৌরভ চৌধুরীর দেহ। এ নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হয়। বারাসত আদালতে আজ, মঙ্গলবারও ভাইয়ের মৃত্যুর সেই মামলার সাক্ষ্য দিতে যাবেন সন্দীপ। তাঁর কথায়, “প্রতিবাদের স্বর বন্ধ হয় না। আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পরেও এলাকায় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি।”

অরূপের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও এ দিন প্রশ্ন তোলেন সন্দীপ। তিনি বলেন, “পুলিশও হাত পা গুটিয়ে অন্যায়কে সমর্থন করে চলেছে।” প্রতিবাদ করলেই মৃত্যু, বাংলার সংস্কৃতির হালে নতুন বদল বলে মনে করেন তিনি। সন্দীপের প্রশ্ন, “দোষীরা যদি সাজা না পায়, তা হলে প্রতিবাদীদের খুনের এই ট্র্যাডিশন এ রাজ্যে বন্ধ হবে কী করে?”

saurabh chowdhury aminul islam barun biswas rajib das arup bhandari murder
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy