Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
গালি দিয়ে গ্রেফতার

মমতার নামে কটূক্তি, উকিলই পেলেন না ধৃত

মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে অশালীন মন্তব্য। অভিযোগ পাওয়া মাত্র এক যুবককে গ্রেফতার করলো পুলিশ। আদালতে ধৃতের হয়ে সওয়ালটুকুও করলেন না কোনও আইনজীবী। ফলে জামিনযোগ্য ধারায় গ্রেফতার হয়েও জেল হাজতে যেতে হল অভিযুক্তকে। মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর থানার জানকীনগর এলাকার ঘটনা। ধৃতের নাম বাপি পাল। মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টা নাগাদ বাপির ফেসবুক পোস্ট দেখে থানায় অভিযোগ করেছিলেন তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের জেলা সভাপতি মহম্মদ জমিরুল ইসলাম। রাত বারোটা নাগাদ বাপিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

বাপি মজুমদার
হরিশ্চন্দ্রপুর (মালদহ) শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৯
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে অশালীন মন্তব্য। অভিযোগ পাওয়া মাত্র এক যুবককে গ্রেফতার করলো পুলিশ। আদালতে ধৃতের হয়ে সওয়ালটুকুও করলেন না কোনও আইনজীবী। ফলে জামিনযোগ্য ধারায় গ্রেফতার হয়েও জেল হাজতে যেতে হল অভিযুক্তকে।

মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর থানার জানকীনগর এলাকার ঘটনা। ধৃতের নাম বাপি পাল। মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টা নাগাদ বাপির ফেসবুক পোস্ট দেখে থানায় অভিযোগ করেছিলেন তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের জেলা সভাপতি মহম্মদ জমিরুল ইসলাম। রাত বারোটা নাগাদ বাপিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বুধবার তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ এবং ৬৭ নম্বর ধারায় মামলা রুজু করা হয়। দু’টিই জামিনযোগ্য ধারা। সাইবার মাধ্যমে আপত্তিকর বা অশালীন বার্তা ছড়ানোর অপরাধ প্রমাণ হলে এই দুই ধারায় সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড হতে পারে। এ দিন চাঁচল আদালতে হাজির করানো হয় বাপিকে। কিন্তু তাঁর হয়ে কোনও আইনজীবীই সওয়াল করতে রাজি হননি। জামিনের আবেদনও করা হয়নি। ফলে ধৃতকে জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক।

২২ বছর বয়সি বাপি নিজে ও তাঁর বাড়ির সকলে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী বলে পরিচিত। এ দিন আদালত চত্বরে মাথা নিচু করে বসেছিলেন বাপি। বলছিলেন, “মাথাটা ঠিক নেই। ওই ধরনের মন্তব্য ফেসবুকে লিখে ঠিক করিনি।”

কিন্তু গোটা ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, বাপি পালকে গ্রেফতার করতে তড়িঘড়ি আসরে নামা পুলিশ তৃণমূল নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে হুমকি-অশালীন মন্তব্য করার গুরুতর অভিযোগ উঠলেও হাত গুটিয়ে বসে থাকে কেন? বিরোধীদের অনেকেরই বক্তব্য, বাপি মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে খুবই অশালীন মন্তব্য করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে শাসক দলের অনেক নেতাই তো তাঁর চেয়ে কিছু কম নিন্দনীয় কথা বলেননি।

প্রকাশ্য জনসভায় কেউ বলেছেন, ‘পুলিশকে বোম মারুন’! কেউ বলেছেন, ‘ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে’ দেবেন। কেউ আবার জোর গলায় স্বীকার করেছেন, তিন জনকে ‘পায়ের তল দিয়ে’ মেরে ফেলার কথা। বীরভূম জেলার সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল কিংবা লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম কাউকেই কিন্তু ধরেনি পুলিশ। বরং তাঁদের বাঁচাতে জনগণের করের টাকায় মামলা লড়েছে রাজ্য সরকার। ‘ছোট ঘটনা’ বলে লঘু করে দেখিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। সোনামুখীর তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার বিরুদ্ধে ভোটকর্মীদের মারধর ও ছাপ্পা ভোট দেওয়ানোর অভিযোগ আনে নির্বাচন কমিশন। বিধায়কের হয়ে জামিনের আবেদন করতে নেমে পড়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়!

কিন্তু মালদহের কাজ হারানো সিভিক ভলান্টিয়ার বাপি পালের কপাল তেমন নয়। প্রথমত, তাঁকে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যদিও অতি সক্রিয়তার অভিযোগ উড়িয়ে মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, “ওই যুবক ফেসবুকে অশালীন ভাষা ব্যবহার করে মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছেন। অভিযোগ পাওয়ার পরে হানা দিয়ে পুলিশ তাঁকে পেয়েছে বলেই সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করেছে।”

দ্বিতীয়ত, তাঁর হয়ে সওয়াল করার জন্য কোনও আইনজীবীও পাননি বাপি। কেন? এ দিন দুপুরে চাঁচল বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক তথা অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি গোলাম মুস্তাফা কামাল বলেন, “ওই যুবকের মন্তব্য ছাপার অযোগ্য। তাই এ দিন কোনও আইনজীবীই তাঁর হয়ে দাঁড়াতে চাননি।” যদিও আইনজীবীদের বেঁকে বসার পিছনে রাজনৈতিক চাপ রয়েছে বলেই মনে করছেন এলাকাবাসীরা। গোলাম নিজেও শাসক দলের সমর্থক বলে পরিচিত।

কিন্তু অভিযুক্তের আইনজীবী পাওয়ার অধিকারকে কি এ ভাবে লঙ্ঘন করা যায়? দার্জিলিং লিগাল এড ফোরাম-এর সম্পাদক অমিত সরকার বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে, সব অভিযুক্তকেই আইনজীবী দিতে হবে। সুবিচার পাওয়ার প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই।” সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মির্জা কায়েশ বেগ-ও বলেন, “বিচার শুরুর আগেই এক জন আইনজীবী পাবেন না, এটা হতে পারে না।”

ধৃতের বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী মুকলি পালের দাবি, কাজ হারানোর পর থেকে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন বাপি। সম্ভবত ঝোঁকের মাথায় ওই মন্তব্য পোস্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি ওর হয়ে সকলের কাছে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু তাই বলে কোনও আইনজীবী দাঁড়াবেন না, এটা হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, আমরাও তৃণমূল করি।” বিকেলে অবশ্য এলাকার তৃণমূলের একাংশ পাশে দাঁড়ানোয় পরের দিন ধৃতের হয়ে সওয়াল করার আশ্বাস দিয়েছেন কিছু আইনজীবী।

ফেসবুকে কী লিখেছিলেন বাপি? সম্প্রতি বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তে এনআইএ-র আগমন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দেন ফেসবুকে। ফেসবুকে তৃণমূল সমর্থকদের একটি গোষ্ঠী (টিএমসি সাপোর্টার্স গ্রুপ) রয়েছে। সেই গ্রুপের চঞ্চল মল্লিক নামে এক সমর্থক মুখ্যমন্ত্রীর ওই পোস্ট শেয়ার করেন। সেখানেই বাপি মুখ্যমন্ত্রীকে ‘সব থেকে বড় জঙ্গি’ বলে মন্তব্য করেন। মুখ্যমন্ত্রী ‘রাজ্যের বড় শত্রু ও রাজ্যকে নষ্ট করতে এসেছেন’ বলে অভিযোগ এনে তাঁকে ‘তুই’ সম্বোধন করে অশালীন মন্তব্যও লেখা হয়। অভিযোগকারী জমিরুল ইসলাম বলেন, “ওই মন্তব্যের পিছনে নিশ্চয়ই কোনও অভিসন্ধি রয়েছে। তার তদন্ত প্রয়োজন। তাই পুলিশকে বলি বাপিকে গ্রেফতার করতে হবে।”

অনেকটা একই রকম ঘটনায় এ দিন কৃষ্ণনগরের কোতোয়ালি থেকে গ্রেফতার করা হয় অভিষেক দাস নামে এক যুবককেও। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, এসএফআই কর্মী বলে পরিচিত এই যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তৃণমূল যুবার সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তাঁকে এবং মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে কদর্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন। গত ২৩ জুলাই তৃণমূল যুবার তরফে এ নিয়ে অভিযোগ জানানো হয় লালবাজারের সাইবার অপরাধ দমন শাখায়। বুধবার অভিষেককে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ছাড়াও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৬ ও ৫০৯ ধারাতেও মামলা রুজু হয়েছে। এগুলিও জামিনযোগ্য ধারা। জিজ্ঞাসাবাদের পর অভিষেককে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

বাপির ক্ষেত্রে তবে এত কড়াকড়ি হলো কেন? স্থানীয় তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে ওই যুবককে থানায় নিয়ে আসার পরে শোনা যাচ্ছিল যে, পুুলিশ তাঁকে ‘সতর্ক’ করেই ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু শাসক দলের একাংশ গ্রেফতারের জন্য চাপ বাড়ান বলে অভিযোগ। রাতভর বাপি থানাতেই ছিলেন। কোন ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, তা জানতে এ দিন জেলা পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হরিশ্চন্দ্রপুর থানা।

এ দিন বাপির বাবার সঙ্গে আদালতে আসা তৃণমূল কর্মীদের একাংশকে চেঁচিয়ে বলতে শোনা যায়, “বাপি চোর-ডাকাত নয়। পুলিশ বলেছিল ওকে ধমক দিয়ে ছেড়ে দেবে।” বাপির পরিচিতদের একাংশের দাবি, “ফেসবুক খুললে প্রধানমন্ত্রী-সহ অনেক নেতা-মন্ত্রীকে ঘিরেই নানা মন্তব্য-কার্টুন দেখতে পাওয়া যায়। তা হলে তো রোজই শয়েশয়ে লোকজনের গ্রেফতার হওয়ার কথা।”

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতারের ঘটনার কথা এ প্রসঙ্গে অনেকেরই মনে এসেছে। যদিও ঘটনা দু’টি এক নয়। অম্বিকেশবাবু একটি ব্যঙ্গচিত্র ই-মেলে ফরোয়ার্ড করেছিলেন মাত্র। বাপি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ফেসবুকে কটূক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে যে রকম বিদ্যুৎগতিতে কাজ করতে দেখা গেল, সেটা অন্যত্র দেখা যায় না কেন? কোনও অশালীন উক্তিকেই তিনি সমর্থন করেন না বলে জানিয়ে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, “রাজ্য প্রশাসন তিলকে তাল এবং তালকে তিল করছে। কেউ কার্টুন ফরোয়ার্ড করলে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, আর রেপ করার হুমকি দিলে ছোট ঘটনা! বাস্তবে যারা ভাষা সন্ত্রাস করছে, তাদের কিছু করা হচ্ছে না। আর সাইবার জগৎ থেকে অপরাধী ধরে আনা হচ্ছে।”

বিরোধীরা মনে করাচ্ছেন, যে বর্ধমান বিস্ফোরণকে ঘিরে ফেসবুকে এত বিতর্ক, তার অন্যতম চাঁই ইউসুফ শেখ পুলিশের গাফিলতিতেই পালাতে পেরেছে বলে এনআইএ-র অভিযোগ। তাঁরা মনে করাচ্ছেন, কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকেছে, কিন্তু যাদবপুরে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ উপাচার্যের ডাক পেয়েই ছাত্রদের পিটিয়ে এসেছে। তাঁদের মতে, বাপি পালের ঘটনা রাজ্যের এই আমরা-ওরা সংস্কৃতিতেই আরও একটা দৃষ্টান্ত জুড়ল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE