Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আসানসোলের গতি রুদ্ধ যানজটে

ছোটবেলাটা কেটেছে এই শহরে। তার পরে কলকাতার কলেজে পড়ার সময়ে ছুটিছাটায় বাড়ি ফিরে একঘেয়ে লাগত প্রদীপ চক্রবর্তীর। সময় যেন আর কাটতেই চাইত না। এখন কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুতে। কিন্তু এখন আর বাড়িতে এলে সময়টা মন্দ কাটে না ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপের। ব্যাঙ্ককর্মী পিয়ালী বসু কর্মরত ছিলেন গুরগাঁওয়ে। সম্প্রতি বদলি হয়ে এসেছেন আসানসোলে। জানাচ্ছেন, এখানে আসার পরে তাঁর একেবারেই খারাপ লাগছে না।

হাটন রোডের নিত্য চিত্র। ছবি: শৈলেন সরকার।

হাটন রোডের নিত্য চিত্র। ছবি: শৈলেন সরকার।

সুশান্ত বণিক
আসানসোল শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৪ ০০:৩৩
Share: Save:

ছোটবেলাটা কেটেছে এই শহরে। তার পরে কলকাতার কলেজে পড়ার সময়ে ছুটিছাটায় বাড়ি ফিরে একঘেয়ে লাগত প্রদীপ চক্রবর্তীর। সময় যেন আর কাটতেই চাইত না। এখন কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরুতে। কিন্তু এখন আর বাড়িতে এলে সময়টা মন্দ কাটে না ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপের।

ব্যাঙ্ককর্মী পিয়ালী বসু কর্মরত ছিলেন গুরগাঁওয়ে। সম্প্রতি বদলি হয়ে এসেছেন আসানসোলে। জানাচ্ছেন, এখানে আসার পরে তাঁর একেবারেই খারাপ লাগছে না। গুরগাঁওয়ের মতো ঝাঁ চকচকে শহর না হলেও বিনোদন-সহ নানা প্রয়োজন মেটানোর জিনিসপত্র দিব্যি মিলে যাচ্ছে এখানেও, বলছেন তিনি।

বড় শহরের মতো স্বচ্ছল জীবনযাপনের রকমারি উপকরণের এখন অভাব নেই এই শহরে। শপিং মল থেকে বহুজাতিক নানা সংস্থার শো-রুম, মাল্টিপ্লেক্স থেকে অভিজাত ক্লাবরয়েছে সব কিছুই। গড়ে উঠছে একের পর এক বহুতল। দেড় দশক আগেও অবশ্য ছবিটা অনেকখানি অন্য রকম ছিল।

এঁদো গলি, গরু-মোষের খাটাল, ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে মানুষের বাস শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার ছবিটা তখন ছিল এই রকমই। ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি হয়ে পড়ে ফাঁকা পড়ে থাকত জমি। বাজার বলতে ছিল কিছু সাবেক দোকানপাট। পুজোর সময়ে কেনাকাটা করতে অনেকেই যেতেন কলকাতা বা ধানবাদ। সেই সব শহরের দোকানপাটের জৌলুস দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন আসানসোলবাসী।

পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে এই শতকের গোড়া থেকে। শহরের হাল-হকিকত যে বদলাতে চলেছে, বাসিন্দারা প্রথম বুঝলেন ২০০৫ সালে যখন পোলো মাঠের গায়ে শপিং মলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হল। খবরের কাগজ বা টেলিভিশনে বড় বড় শহরের বাতানকূল শপিং মলের ছবি দেখে অভ্যস্ত আসানসোলের মানুষ হাতের কাছে তা পেয়ে গেলেন ২০০৯ সালে। এর মধ্যে একে এক করে নানা বড় সংস্থা শো-রুম গড়ে তুলেছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বস্ত্র, গয়নার বিপণিতে গিয়ে কেনাকাটা, দিনের কাজকর্ম শেষে সন্ধ্যার দিকে ক্লাবে আড্ডা-বিনোদন, রাতে রেস্তোঁরায় খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ি ফেরায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন শহরবাসী।

এক সময়ে ধারণা ছিল, খনি অঞ্চল আসানসোলে বহুতল গড়া বিপজ্জনক। কারণ, কয়লার স্তর কেটে নেওয়ার পরে ফাঁপা হয়ে রয়েছে আশপাশের ভূগর্ভ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণাও ভেঙে গিয়েছে। শহর ও লাগোয়া এলাকায় একের পর এক গড়ে উঠছে বহুতল আবাসন। ফলে, শহরের পরিধিও বাড়ছে। একাধিক নির্মাণ সংস্থা ব্যবসার জন্য বেছে নিয়েছেন এই শহরকেই। চাহিদাও তুঙ্গে। আধুনিক ভাবে তৈরি সুসজ্জিত আবাসন কেনার চাহিদা এই শহরে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন একটি নির্মাণ সংস্থার কর্ণধার বিষ্ণু হরলালকা। শহরের এক আবাসন ব্যবসায়ী ববি চৌধুরী বলেন, “গত ১৫ বছরে এই শহরে অন্তত পাঁচ হাজার আবাসন তৈরি হয়েছে। ক্রমশ শহর ছাড়িয়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে এই ব্যবসা। শুধু যে এই শহরের বাসিন্দারাই নন, পার্শ্ববর্তী জেলা এমনকী আশপাশের রাজ্যের মানুষও আসানসোলে এসে বাস করছেন। কারণ, এই শহরে এখন সমস্ত রকমের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা মেলে।”

কিন্তু চড়চড় করে আধুনিক হয়ে ওঠা শহরের গতি রুদ্ধ হয়ে পড়ছে শহরের রাস্তায়। রাস্তাঘাটের উন্নতি না হওয়ায় শহরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গিয়েছে সেই যানজট। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বড় বড় রাস্তা খানা-খন্দে ভরে রয়েছে। বর্ষায় জল জমে প্রায়শয়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। শহরের বড় রাস্তা জিটি রোড ও এসবি গরাই রোডে দিনভর যানজটে অতিষ্ঠ মানুষজন। যখন-তখন মাল বোঝাই গাড়ি ঢোকা-বেরোনো, পণ্য তোলা-নামায় লাগাম না পরানোর ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। পথচারীর সমস্যা বাড়িয়েছে জবরদখল হয়ে যাওয়া ফুটপাথ। আসানসোল বাজার, এসবি গড়াই রোডের দু’পাশ বেআইনি দখলের জেরে রাস্তা আরও সরু হয়ে গিয়েছে।

সমস্যা রয়েছে নিকাশিতেও। রাস্তায় যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে জঞ্জাল। শহরের আবর্জনা ফেলা হয় কালিপাহাড়িতে। জাতীয় সড়ক ধরে কলকাতার দিক থেকে আসার সময়ে আসানসোলে ঢোকার মুখেই পড়ে এই কালিপাহাড়ি। শুরুতেই এই জঞ্জালের দুর্গন্ধ বাইরে থেকে আসা মানুষজনের কাছে শহর সম্পর্কে খুব একটা ভাল ধারণা তৈরি করে না, মত বাসিন্দাদের একাংশের।

সমস্যা রয়েছে জলেরও। বছরভর পানীয় জল পেতে সমস্যায় ভোগেন নাগরিকেরা। পুরসভার জলপ্রকল্প এখনও শেষ না হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগেরও শেষ হয়নি। পুর এলাকার এমন অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে নিয়মিত জল পৌঁছয় না। পুর কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, রেললাইন ও জাতীয় সড়কের কাছে পাইপলাইন পাতার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা এখনও না মেটায় কিছু এলাকায় জল সরবরাহে সমস্যা রয়েছে। তবে তা শীঘ্রই মিটে যাবে।

জল, রাস্তার মতো পরিকাঠামোর নানা সমস্যা প্রভাব ফেলছে শিল্পেও। এক দিকে রাষ্ট্রায়ত্ত নানা সংস্থার পুনরুজ্জীবনের উপরে ভর করে আধুনিক রূপ পাচ্ছে শহর, তারই পাশে পরিকাঠামো-সহ নানা সমস্যায় পড়ে ধুঁকছে নানা বেসরকারি কারখানা।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

asansol sushanta banik traffic jam amar sohor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE