ভোটের ঢাকি কাঠি মানেই ঘরছাড়া হওয়ার প্রহর গোনা।
বছরের পর বছর ধরে জামুড়িয়ায় বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকেরা এমনটাই মনে করে এসেছেন। সময়ে-সময়ে পাল্টে গিয়েছে বিরোধী দলের নাম। কিন্তু পাল্টায়নি পরম্পরা।
ঘরছাড়া হওয়া শুরু ১৯৯৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে। সে বারই প্রথম ভোটের আসরে নামে তৃণমূল। জেতার ‘অপরাধে’ ঘরছাড়া হন মদনতোড় পঞ্চায়েতের সত্তর গ্রামের তৃণমূল নেতা নীলকণ্ঠ পাল ও তাঁর কয়েক জন সঙ্গী। সে বার ১৫ অগস্ট ওই গ্রামে তৃণমূল নেতা মলয় ঘটকও আক্রান্ত হন বলে অভিযোগ। ঠিক ১৪ বছর আগে ভোটে জেতার পরে সেই সত্তর গ্রামেই বিজেপি-র কর্মীকে ঘরছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বিজেপি-র দয়াময় নন্দী ও সিপিএমের শ্যামাপদ বাউড়িকে ঘরছাড়া করার ব্যাপারে সেই নীলকণ্ঠবাবুই নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ। সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় নিজে এসে ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন দয়াময়বাবুকে। তবে সিপিএমের পোলিং এজেন্ট শ্যামাপদবাবু এখনও ঘরে ফিরতে পারছেন না বলে সিপিএমের অভিযোগ।
জামুড়িয়ারই তালতোড় গ্রাম থেকে সে বার ঘরছাড়া হয়েছিলেন তৃণমূল নেতা অলোক দাস ও তাঁর দাদা বিনয় দাস। বিনয়বাবু অভিযোগ করেন, পঞ্চায়েত ভোটের দিন তাঁরা ছাপ্পার প্রতিবাদ করলে পর দিন আবার সেখানে ভোটগ্রহণ হয়। বিনয়বাবুর কথায়, “ভোট শেষ হওয়ার পরে সেই রাতেই আমাদের বাড়িতে চড়াও হয়ে সিপিএমের ছেলেরা আমাকে ও আমার ভাইকে মারধর করে। তার পর তারা বাড়ি ফিরে যায়। ওদের ভয়ে আমাদের হাসপাতাল নিয়ে যাননি কোনও এলাকার কোনও গাড়িচালক। রাত ১১টা নাগাদ অন্য এলাকা থেকে আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু গাড়ি নিয়ে এসে আমাদের আসানসোল হাসপাতালে নিয়ে যান।” বিনয়বাবু জানান, তার পরে তাঁরা ভানোড়া কোলিয়ারি এলাকায় দিদির বাড়িতে থাকতেন। সেখানে অলোকবাবু হকারের কাজ ও তিনি চায়ের দোকান খোলেন। কিন্তু মাসখানেক যেতে না যেতেই সেই দোকানও জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে তাঁর অভিযোগ। তিনি জানান, এর পরে কোলিয়ারি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ক্যান্টিন চালান। বিনয়বাবুর দাবি, “বছর দুয়েক পর জামুড়িয়ার তৎকালীন ওসি আমাদের ডেকে বলেন, বিবাদে না গিয়ে সিপিএমের সঙ্গে আপস করে গ্রামে ফিরুন।” তার পরে বাড়ি ফিরলেও সেই ঘটনা ভুলতে পারেন না, দাবি তাঁর।
১৯৯৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের পরে ঘরছাড়া হতে হয়েছিল তালতোড় গ্রামের ভাগ্যধর মাজিকেও। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর জমিতে চাষ করার জন্য খেতমজুরর পাঠালে সিপিএম সমর্থকেরা কাজ করতে দেয়নি। এভাবে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ওই মাঠে চাষ করতে পারেননি তিনি। অবশেষে ওই সিপিএম সমর্থকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিলে তাঁকে চাষ করার ও গ্রামে ফেরার ‘অনুমতি’ দেয়। এ বার ভাগ্যধরবাবু পঞ্চায়েত সমিতিতে তালতোড় এলাকা থেকে নির্বাচিত তৃণমূল সদস্য। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল করার ‘অপরাধে’ মানিক পালের পরিবারের উপরে হামলার অভিযোগ ওঠে সিপিএম কর্মীদের বিরুদ্ধে। ১৯৯৯ সালের ১৩ এপ্রিল কেন্দা গ্রামের হাটে গুলিতে খুন হন সিপিএম নেতা মোহিত বাউড়ি। ওই গ্রামের তৃণমূল নেতা সুকুমার ভট্টাচার্যের দাবি, “সিপিএম আমাদের যে কোনও ভাবে জব্দ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ওই খুনের সঙ্গে আমাদের জোর করে ওরা জড়িয়ে দেয় ওরা। বাড়ি ভাঙচুর করে একেবারে খণ্ডহর তৈরি করে। আমরা এক দল তৃণমূল কর্মী আসানসোলে মলয় ঘটকের বাড়িতে দীর্ঘদিন আশ্রয় নিয়েছিলাম। তার পরে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের আগে গ্রামে ঢুকলেও স্থায়ী ভাবে বসবাসের সাহস পাই পরের বছর লোকসভা নির্বাচনের পরে।”
বাম আমলে তৃণমূলের লোকজনকে যে ভাবে ঘরছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে একের পর এক, ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে ঠিক সেই অভিযোগের আঙুল উঠতে শুরু করে তাদের দিকেই। যেমন, কৃষ্ণনগর কোলিয়ারি এলাকার সিপিএম সমর্থক গুরুদাস পাসোয়ান ও মন্টু মণ্ডল ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের পর থেকেই ঘরে ঢুকতে পারছেন না বলে অভিযোগ। এই পরম্পরারই যেন শেষ সংযোজন সত্তর গ্রামের ঘটনা।
বাম আমলে যেমন বিরোধীদের ঘরছাড়া করার কথা মানেনি সিপিএম, তেমনই এখন তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ মানতে রাজি নন তৃণমূলের নেতারা। সিপিএমের অজয়-জোনাল কমিটির সম্পাদক মনোজ দত্তের যেমন অভিযোগ, “আমরা কাউকে ঘরছাডা করিনি। বরং, ক্ষমতায় এসেই ওরা আমাদের চুরুলিয়ার কর্মী সন্তোষ বাউড়িকে ঘরছাড়া করেছে। সে এখনও ঘরে ফিরতে পারেনি।” সত্তরে শ্যামাপদবাবুকে ঘর ফেরাতেও তাঁরা ভয় পাচ্ছেন বলে মনোজবাবুর দাবি। প্রশাসনের সহযোগিতায় বাড়ি ফেরাতে চাইছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। তৃণমূল নেতা অলোক দাসের বক্তব্য, “আমরা কাউকে ঘরছাডা করিনি। ওরা আমাদের বদনাম করতেই এমন অভিযোগ আনছে। আমাদের কর্মীরা এখন সিপিএম ও বিজেপি-র যৌথ সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন।” বিজেপি-র জেলা সভাপতি নির্মল কর্মকারের প্রতিক্রিয়া, “সন্ত্রাসের শিকার কারা হচ্ছে, মানুষ পরিষ্কার হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy