কাটা হাত নিয়েই পুজোর তোড়জোড়। নিজস্ব চিত্র।
খড়ের কাঠামোয় মাটি পড়েছে। প্রতিমায় রং লাগানোও প্রায় শেষ। জানলায় বসে মৃন্ময়ী মূর্তির চিন্ময়ী হওয়ায় প্রতিটা খুঁটিনাটি কাজে নজর রাখছেন তিনি। একা হাতে নয়, ‘এক হাতে’ই দশভুজার দশদিক সামলাচ্ছেন কাটোয়ার কাছারি পাড়ার এই ‘দুর্গা’।
রঙচটা দেওয়াল আর নড়বড়ে দরজার একতলা বাড়িতে বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে থাকেন মালা বন্দ্যোপাধ্যায়। বয়সের ভারে জবুথবু বৃদ্ধা জানান, মহালয়া এলেই পঁচিশ বছর আগেকার অভিশপ্ত সন্ধ্যাটার কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। বলে চলেন, মালা তখন সবে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। পাড়ার একটা ছেলে খুব উত্যক্ত করত। ওই দিন একেবারে বাড়িতে ঢুকে মেয়ের হাতে বসিয়ে দিয়েছিল রামদার কোপ। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ, হাসপাতালে ছুটোছুটি। অভিযুক্ত যুবক ধরা পড়েছিল। দশ বছর জেলও হয়েছে। কিন্তু কাটা হাতটা জোড়া লাগেনি মালাদেবীর।
সে বছর পুজোটা ‘অভিশপ্ত’ কেটেছিল তাঁদের। কিন্তু যন্ত্রণার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে রাজি হননি তিনি। একটু বড় হতেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, যে দুর্গা আসার আগে জীবন বদলে গিয়েছিল সেই দুর্গার আরাধনা করবেন নিজে হাতে। যাতে তাঁকে দেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শেখে প্রত্যেকটা মেয়ে।
পুজোর সরঞ্জাম গুছোতে গুছোতে মালাদেবী বলেন, ‘‘আমার বাড়ির উল্টো দিকেই ওই দুষ্কৃতীর বাড়ি ছিল। ও সাজা পেয়ে যাওয়ার পরে পাড়ার সকলকে অনুরোধ করে ওখানেই দুর্গামন্দির গড়ি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শক্তি ওখান থেকেই পাই।’’
এখনও সর্বজনীন ওই পুজোয় শিতুলী মোদক, পৌলমী সিংহ, ঋষিতা দাস, সঞ্চারী দাসদের সঙ্গে সমান তালে খেটে চলেন তিনি। পুজোর আগে ফর্দ তৈরি থেকে পুজোর চার দিন ফল কাটা, আলপনা দেওয়া— এক হাতেই বাজিমাত করেন তিনি। মালাদেবীর মা জানান, অভাবের সংসারে মেয়ের নকল হাত লাগানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি কোনওদিন। এখনও মনে হয় মেয়েকে দু’হাতের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হতেন। কিন্তু মেয়ে কখনও মুখ ফুটে সে কথা বলে না বলেও জানান তিনি।
কিন্তু এক হাতে তো দুর্গাকে হাত জোড় করে প্রণামও করতে পারেন না, কষ্ট হয় না? হাসিমুখে মালাদেবী বলেন, ‘‘প্রণাম তো মনে। মনে মনে হাত জোড় করেই মাকে বলি, পাড়ার মেয়েগুলোকে বাঁচিও। ওদের যেন কখনও এমনটা না হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy