Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

ওরা এত পড়ল কখন

সুমনের রেজাল্ট চমকে দিয়েছে দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। চমকেছেন বাড়ির লোকেরাও। ছেলে এত পড়ল কখন, ভাবছেন তাঁরা। কলা বিভাগের ছাত্র সুমন কিন্তু ঠিক পড়ার সময় বার করে নিয়েছে

সফল: সুমনকুমার দাস, ননীগোপাল মণ্ডল, আশালতা নন্দী এবং সুপ্রিয় ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

সফল: সুমনকুমার দাস, ননীগোপাল মণ্ডল, আশালতা নন্দী এবং সুপ্রিয় ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কাটোয়া ও কালনা শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৭ ০১:০০
Share: Save:

মাধ্যমিকে দ্বিতীয় ডিভিশন। তার পরে বাড়ির আর্থিক অবস্থার যে রাতারাতি পরিবর্তন হয়েছে, তা নয়। অভাব যেমন ছিল, তেমনই আছে। কিন্তু, সুমনকুমার দাস জেদ ধরেছিল, উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল করার। এবং করেছেও। দু’বছরের মধ্যেই নম্বর ৬০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯৫ শতাংশ!

সুমনের রেজাল্ট চমকে দিয়েছে দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। চমকেছেন বাড়ির লোকেরাও। ছেলে এত পড়ল কখন, ভাবছেন তাঁরা। কলা বিভাগের ছাত্র সুমন কিন্তু ঠিক পড়ার সময় বার করে নিয়েছে। একান্নবর্তী পরিবারে, এক কামরার ছোট্ট ঘরে এক মনে শুধু পড়াশোনা করেছে। রাত জেগে পড়েছে। তারই ফল, ৩৫ শতাংশের ওই বৃদ্ধি! দাঁইহাটের বাগটিকরায় বাড়ি সুমন পেয়েছে ৪৭৫ নম্বর। ছোট্ট তেলেভাজার দোকানের আয়েই সুমনের বাবা প্রভাতবাবু ও দুই কাকার সংসার চলে। কিন্তু, অভাব পড়ার পথে বাধা হতে পারেনি মেধাবী সুমনের। তার কথায়, ‘‘ইংরেজিতে স্নাতক পড়তে চায়। ইচ্ছে আছে কলকাতার কোনও নামী কলেজে পড়ার।’’ তবে চিন্তা সামর্থ্য নিয়ে। সুমনের মা রূপালিদেবী বলন, ‘‘জানি না কী ভাবে পড়াব।’’

চরম অভাবের সঙ্গে লড়ে সফল হয়েছে কাটোয়ার দেয়াসিন বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের ছাত্র ননীগোপাল মণ্ডল। উচ্চ মাধ্যমিক কলা বিভাগে পড়ে সে পেয়েছে ৪৪৩ নম্বর। কখনও মাটি কেটে,কখনো বা অন্যের জমির ফসল বয়ে দিনে ৮০ বা ১০০ টাকা রোজগারে চলে সংসার। সারা বছর কাজও জোটে না। অনটন সত্ত্বেও ছেলের পড়ায় ছেদ পড়তে দেননি ননীগোপালের দিনমজুর বাবা, খাসপুরের বাসিন্দা মানব মণ্ডল। বাবার পরিশ্রমের মুখ রেখেছে ছেলে। একতলা মাটির বাড়িতে বাস তাদের। মাধ্যমিকেও ননীগোপাল পেয়েছিল ৭০% নম্বর। পড়ার খরচ চালাতে ছাত্র পড়ায় সে। সেই সামান্য টাকায় বইপত্র কিনে এত দিন পড়া চালিয়েছে। মানববাবু বলেন, ‘‘ভূগোল নিয়ে পড়তে চায় ছেলে। শুনেছি তাতে অনেক খরচা।’’

বাবা তাঁত বুনে তিন ভাইবোনের পড়াশোনা চালান। কোন কোন বছর সিলেবাসের সব বইও কিনে দিতে পারেননি মেয়েকে। তবু সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কাটোয়ার ঘোড়ানাশ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী আশালতা নন্দী উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছে ৪১৮। বাবা গৌতম নন্দীর আক্ষেপ, ‘‘মাস গেলে হাজার তিনেক রোজগার হয়। গৃহশিক্ষকও দিতে পারিনি। এক জন শিক্ষক একটুআধটু সব বিষয়গুলোই দেখিয়ে দিতেন।’’ মাধ্যমিকে ৫৫% পাওয়ার পর থেকেই জেদ চেপে যায় উচ্চ মাধ্যমিকে আরও ভাল ফল করার। বাংলায় স্নাতক পড়তে চায় আশালতা।

অভাব তীব্র কালনা ১ ব্লকের কাঁকুরিয়া গ্রামের সুপ্রিয় ঘোষের পরিবারেও। মাটির গাঁথনিতে টালির ঘর। দমকা হাওয়ায় যে কোনও সময় হুড়মুড়িয়ে পরে যেতে পারে এক কামরার সে ঘর। ওই অভাব নিয়েই উচ্চ মাধ্যমিকে ৪০২ নম্বর পেয়েছে কাঁকুরিয়া দেশবন্ধু উচ্চবিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ছাত্র সুপ্রিয়। তিন বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছে সে। মা শিখা ঘোষ অতি কষ্টে ছেলেকে মানুষ করেছেন। কয়েক কাঠা চাষের জমি চুক্তিচাষ করিয়ে যে সামান্য আয় হয়, তা দিয়েই মা-ছেলের বছর চলে। শিখাদেবীর কথায়, ‘‘ছেলেকে ভাল বইপত্র কিনে দিতে পারেনি। মুখে তুলে দিতে পারিনি ভাল খাবার। তার মধ্যেও ও ভাল ফল করেছে। তবে আর পড়াতে পারব কিনা, জানি না।’’

এখনও কলেজে ভর্তির টাকা জোগাড় হয়নি।তার স্কুলের শিক্ষক সুশান্ত সরকার জানান, অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সুপ্রিয়। ভাল সুযোগ পেলে ও অনেকদূর এগোবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Higher Secondary উচ্চ মাধ্যমিক
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE