Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

অধ্যক্ষকে যেতে দেবে না, এককাট্টা কলেজ

অধ্যক্ষকে ধরে মারধর বা নিদেন পক্ষে ঘণ্টা ছয়েক ঘেরাও করে রাখা নয়। বরং অধ্যক্ষ চলে যাবেন শুনে কেঁদে ভাসাচ্ছে টিএমসিপি। শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের অন্য চেহারা দেখতেই সাধারণত এ রাজ্য অভ্যস্ত। রায়গঞ্জ থেকে মাজদিয়া বা ঘাটাল— অধ্যক্ষকে নিগ্রহ থেকে শুরু করে কলেজে-কলেজে টিএমসিপি-র দাদাগিরি প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে দস্তুর। কেতুগ্রামের কান্দরা রাধাকান্ত কুণ্ডু মহাবিদ্যালয়ে সেই নিয়মটাই উল্টে গিয়েছে।

বিক্ষোভে ঘেরাও নয়। অন্য কলেজে চলে যাচ্ছেন অধ্যক্ষ। তাঁকে আটকাতে পড়ুয়াদের অবস্থান। বৃহস্পতিবার কান্দরার কলেজে। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিক্ষোভে ঘেরাও নয়। অন্য কলেজে চলে যাচ্ছেন অধ্যক্ষ। তাঁকে আটকাতে পড়ুয়াদের অবস্থান। বৃহস্পতিবার কান্দরার কলেজে। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

সৌমেন দত্ত
কেতুগ্রাম শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৫৭
Share: Save:

অধ্যক্ষকে ধরে মারধর বা নিদেন পক্ষে ঘণ্টা ছয়েক ঘেরাও করে রাখা নয়। বরং অধ্যক্ষ চলে যাবেন শুনে কেঁদে ভাসাচ্ছে টিএমসিপি।

শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের অন্য চেহারা দেখতেই সাধারণত এ রাজ্য অভ্যস্ত। রায়গঞ্জ থেকে মাজদিয়া বা ঘাটাল— অধ্যক্ষকে নিগ্রহ থেকে শুরু করে কলেজে-কলেজে টিএমসিপি-র দাদাগিরি প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে দস্তুর। কেতুগ্রামের কান্দরা রাধাকান্ত কুণ্ডু মহাবিদ্যালয়ে সেই নিয়মটাই উল্টে গিয়েছে।

সদ্য জানাজানি হয়েছে, অধ্যক্ষ মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায় অন্য কলেজে চলে যাচ্ছেন। তাঁর যাওয়া আটকাতে বৃহস্পতিবার আন্দোলন শুরু করেছেন ছাত্রছাত্রীরা। টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের নেতৃত্বে ‘প্রিন্সিপ্যাল স্যারের চলে যাওয়া চলবে না’ পোস্টার লিখে গেটের সামনে বসে পড়েছেন অনেকে।

শুধু টিএমসিপি বা অন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই নন, অবস্থানে বসে পড়েন অন্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরাও। অবস্থা দেখে কাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মৃণালবাবুও। তাঁকে ঘিরে ধরে সকলে আব্দার জানাতে থাকেন, কোনও ভাবেই কলেজ ছেড়ে যাওয়া চলবে না। আপাতত বুঝিয়ে-সুজিয়ে তাঁদের শান্ত করেন অধ্যক্ষ।

কোন জাদুতে সকলে এমন বশ?

কান্দরার ওই কলেজের ইতিহাস বলছে, ২০০১-এ তৈরি হওয়ার পরে প্রথম পাঁচ বছর কোনও অধ্যক্ষ ছিলেন না। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে নলহাটি কলেজ থেকে আসেন বোলপুরের বাসিন্দা মৃণালবাবু। বাড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরত্ব নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তাঁর হাত ধরেই ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ায় আড়াই হাজার পড়ুয়ার নতুন কলেজ। আসন বাড়ে, বাড়ে ক্লাসঘর, খেলার মাঠের সংস্কার হয়। প্রতি বছর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকদের এনে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনাচক্রেরও আয়োজন হয়।

কিন্তু এর থেকেও বড় সাফল্য সম্ভবত কলেজে রাজনৈতিক অশান্তির ছায়া পড়তে না দেওয়া। ২০০৯-এ লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই রাজনৈতিক হানাহানির অন্যতম কেন্দ্র ছিল বর্ধমানের কেতুগ্রাম। দিনের পর দিন খুন, বোমাবাজিতে দোকানপাট খোলা যেত না। কিন্তু সেই সময়েও কলেজের ভিতরে কোনও অশান্তি হয়নি। তার পরেও, রাজ্যের বেশ কিছু কলেজে যখন অধ্যক্ষ নিগ্রহ কার্যত অভ্যেসে পরিণত হয়েছে, মৃণালবাবুর অসম্মান হতে পারে এমন কিছু করার কথা কান্দরা কলেজের ছেলেমেয়েরা ভাবতেও পারেননি।

মৃণালবাবু বলেন, ‘‘আসলে প্রথম দিন থেকেই ছাত্রছাত্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, আমরা তোমাদের জন্যই আছি। কলেজের উন্নয়ন ও পড়ুয়াদের দাবি মেটানো আমাদের দায়িত্ব। সন্তানের মতো যত্ন করেছি কলেজটাকে। তাই কোনও বিক্ষোভ হয়নি।’’ বরং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে, স্নেহ-শ্রদ্ধার বাঁধনেই বাঁধা থেকেছে। এখন যখন সেই বাঁধন ছেঁড়ার সময় এসেছে, কেউ তা মানতে পারছে না।

মৃণালবাবু কান্দরা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হলেও এর আগে তিনি বেশ কিছু কলেজে পড়িয়েছেন। হুগলির বাগাটি শ্রীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় কলেজ, পুরুলিয়ার ঝালদা কলেজ, বীরভূমের হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ, পশ্চিম মেদিনীপুরে গড়বেতা কলেজে অধ্যাপনার পরে নলহাটি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। গত মার্চে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান তিনি। সব ঠিক থাকলে মে মাসে তাঁর সেখানে যোগ দেওয়ার কথা। তার জন্য তিনি কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। সেই থেকেই শিক্ষাকর্মী, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরা খবর জেনে যান।

কলেজের ছাত্রী কবিতা খাতুন, সুমন চুনারি, শবনম সুলতানাদের কথায়, ‘‘আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে ভাল সম্পর্ক রয়েছে স্যারের। আমরা কেউ চাই না, উনি চলে যান।’’ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস বলেন, ‘‘স্যার আমাদের পিতৃস্থানীয়। উনি এমনিই আমাদের কথা বোঝেন।
তাই কখনও কোনও কারণেই বিক্ষোভ করতে হয়নি। স্যারকে আমরা ছাড়ব না, তা হলে কলেজের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে যাবে।’’

সিপিএমের কেতুগ্রাম ১ লোকাল কমিটির সদস্য, কাটোয়া কলেজের শিক্ষক আবুল কাদেরও বলেন, ‘‘খুব ভাল কাজ করেছেন উনি। ছাত্রদের সঙ্গে সদ্ভাব রেখেছেন। তাই ছাত্রেরা প্রিয় শিক্ষককে যেতে দিচ্ছে না।’’ শুধু তো পড়ুয়ারা নন। কান্দরা কলেজের শিক্ষাকর্মী দেবেন্দ্রনাথ সাহা জানান, ‘‘খবরটা শোনার পর থেকে সকলেরই খুব মন খারাপ।’’

মৃণালবাবু তুলনায় বড় কলেজে, বাড়ির কাছের কলেজে আসার সুযোগ পাওয়ায় খুশি তাঁর বাড়ির লোকজন। কিন্তু কান্দরা কলেজের আবেগ ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁদেরও। তাঁর স্ত্রী অর্পিতাদেবী বলেন, ‘‘উনি কখনও ছাত্র বিক্ষোভের মুখে পড়েননি। সেখানে এখন ওঁকে ছাড়তে না চেয়ে বিক্ষোভ হচ্ছে শুনে খুব গর্ব হচ্ছে।’’

সব দেখে-শুনে মৃণালবাবু কিন্তু পড়েছেন দোটানায়। শুধু বলছেন— ‘‘বড় ধর্মসঙ্কটে পড়ে গেলাম যে!’’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE