জ্বলছে আগুন। নিজস্ব চিত্র
কয়লা উত্তোলনে বদলে যাবে এলাকার অর্থনীতির চেহারা, এই আশা রয়েছে জামুড়িয়ার চুরুলিয়া, জয়নগর-সহ একাধিক গ্রামের বাসিন্দাদের। কিন্তু চুরুলিয়ার বন্ধ খনিতে আগুন, ধোঁয়া সেই আশায় জল ঢালার আশঙ্কাকেই উস্কে দিয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, অবৈধ খননের রমরমা যেমন আগুনে-বিপত্তি বাড়িয়েছে, তেমনই সমস্যা তৈরি হচ্ছে এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য নিয়েও। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের দাবি, চালু হোক খনি।
কেন বার বার আগুন
১৯৯৬-এ কেন্দ্রীয় সরকারের কয়লা মন্ত্রক পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরকে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেয়। কিন্তু ২০১৫-য় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যে বেসরকারি সংস্থা কয়লা উত্তোলনের কাজ করছিল, সেই সংস্থার বরাত খারিজ হয়। তার পরে থেকে খনিটি বন্ধ। কিন্তু শুরু হয় ব্যাপক অবৈধ খনন, তা-ও পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে, অভিযোগ এলাকাবাসীর। এর জেরে অবৈধ খনি মুখ (র্যাটহোল) দিয়ে অনবরত অক্সিজেন খনিগর্ভে ঢুকছে। কয়লার স্তরে সঞ্চিত মিথেনের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আগুন ধরে খনিতে কয়েকশো মিটার পর্যন্ত কয়লার স্তর তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। আর তাই প্রায়ই লোকালয়ের অদূরে ভূ-পৃষ্ঠেও সম্প্রতি আগুন, ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আগুন অবশ্য নিয়ন্ত্রণে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
কিন্তু অবৈধ খনন বন্ধ করা যায়নি কেন? খনি চত্বরে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার রক্ষীরা রয়েছেন। তেমনই দুই রক্ষী আনসার মণ্ডল, শেখ বদরুলদের বক্তব্য, ‘‘অবৈধ কয়লার কারবারিরা দলে ভারী। ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র, আর আমাদের হাতে বড় জোর লাঠি থাকে। ফলে আমাদের পক্ষে অবৈধ খনন বন্ধ করা সম্ভব নয়।’’ যদিও আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের এসিপি (সেন্ট্রাল) অলোক মিত্রের দাবি, ‘‘অবৈধ খনন হচ্ছে না। তেমন খবর পেলেই আমরা তা বন্ধ করি।’’
বিপন্ন জনজীবন
পুলিশ, প্রশাসন যা-ই দাবি করুক, খনি চত্বর ও লাগোয়া এলাকা থেকে সম্প্রতি লাগাতার ধোঁয়া, আগুন বার হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করছে অবৈধ খননে রাশ টানা যায়নি, দাবি খনি লাগোয়া জয়নগর, চুরুলিয়া, চিচুরবিল, লোদা-সহ একাধিক গ্রামের বাসিন্দাদের। তাঁরা জানান, লাগাতার ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে অনেকের। চিকিৎসক সমরেন্দ্রকুমার বসু বলেন, “ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট বাড়বে। প্রবীণ ও শিশুদের পাশাপাশি হাঁপানি ও হৃদরোগে আক্রান্তদের সমস্যা হবে।’’
শুধু তাই নয়, প্রভাব পড়তে পারে এলাকার চাষাবাদেও। জামুড়িয়া ব্লক কৃষি দফতরের আধিকারিক আশিস ইকবাল জানান, দীর্ঘদিন ধরে কয়লা স্তর থেকে ধোঁয়া বার হলে লাগোয়া এলাকার কৃষিজমির উর্বরতা কমে যায়। পাতায় ছাই জমার ফলে গাছের সালোকসংশ্লেষ বন্ধ হয়ে যায়।
তবে সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এলাকায় ধস নামা নিয়ে। এ বিষয়ে কোল ইন্ডিয়ার প্রাক্তন আধিকারিক তথা বিশিষ্ট খনি বিশেষজ্ঞ অনুপ গুপ্তের আশঙ্কা, ‘‘লাগাতার আগুনে কয়লার স্তর পুড়ে গেলে উপরিভাগের মাটি আলগা হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় ধস নামতে পারে।’’
খনি চালু কবে
বাসিন্দাদের দাবি, দীর্ঘমেয়াদী ভাবে সমস্যা মেটাতে খনি চালু ও সম্প্রসারণ করা দরকার দ্রুত। কিন্তু গত কয়েক বছরেও খনিটি চালু করা যায়নি। এলাকা সূত্রে জানা গেল, জমি-জটের জেরেই এই পরিস্থিতি। তবে চুরুলিয়া, জয়নগরে জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে বিস্তর টালবাহানার পরে এই জট কাটার খানিকটা ইঙ্গিত মিলেছে। নিগমের তরফে সুজিত সরকার বলেন, ‘‘একর প্রতি জমির মালিককে ১৬ লক্ষ টাকা ও বর্গাদারকে চার লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এ ছাড়া জয়নগর হয়ে বীরকুলটি পর্যন্ত রাস্তা ও নর্দমা তৈরিরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পেলেই খনি চালু হবে। প্রথমে অধিগৃহীত জমিতে কাজ শুরুর পরে খনি সম্প্রসারণেরও কাজ হবে।’’ চুরুলিয়া পঞ্চায়েতের জয়নগরের সদ্য নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য নিমাই বাদ্যকর, জয়নগরের বাসিন্দা জমির মালিক সব্যসাচী ভট্টাচার্য, নাড়ুগোপাল ভট্টাচার্যেরাও বলেন, ‘‘এই দামে আপত্তি নেই। খনি হোক, আমরা চাই।’’ তবে তাঁদেরও প্রশ্ন, ‘খনির কাজ কবে শুরু হবে?’
কিন্তু খনি যখনই খনি চালু হোক, তত দিন কি এ ভাবে ধোঁয়া বার হবে, কখনও বা আগুন ধরবে খনিতে, এ সব নিয়ন্ত্রণের উপায় কী, সে সব প্রশ্নও উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy