• ২০০৯-এর ৭ মে লোকসভা ভোটের দিন আসানসোলের সেটে কন্যাপুরের বুথে দুষ্কৃতী হামলা, গুলিতে খুন অক্ষয় বাউড়ি।
• পাঁচ অভিযুক্তের মধ্যে গ্রেফতার তিন জন।
• চার্জশিট জমা পড়েছে। ধৃতেরা জামিনে মুক্ত।
• আসানসোল আদালতে এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।
গরমের দুপুরে প্রাথমিক স্কুলের সামনে এঁকেবেঁকে এগোচ্ছিল ভোটারদের লম্বা লাইনে। তেমন তাড়াহুড়ো নেই কারও। ভোটগ্রহণ চলছে ধীরেসুস্থে, নির্বিঘ্নে। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন উর্দিধারীরা। কয়েক জনের হাতে লাঠি, কয়েক জনের বন্দুক। হালচাল দেখে তাঁরাও খানিকটা নিশ্চিন্তে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে পাল্টে গেল গোটা আবহটা। আচমকা প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল বুথ চত্বর। আর তার পরেই স্কুলের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ল জনা কয়েক যুবক। কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, কারও হাতে বোমা। মুড়ি-মুড়কির মতো দেওয়ালে আছড়ে পড়ছিল বোমাগুলো। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, বুথের মধ্যে ঢুকে ছাপ্পা দিতে শুরু করে ওই সব দুষ্কৃতীরা। ভোটারেরা তখন যে যে দিকে পারছেন দৌড়চ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে তাণ্ডবের প্রতিবাদ করতে এগিয়ে এসেছিলেন এক যুবক। তার খানিক আগেই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। দুষ্কৃতীরা রেয়াত করেনি তাঁকে। গলায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দেয়। মাটিতে পড়ে থাকে অক্ষয় বাউড়ির দেহ।
২০০৯ সালের ৭ মে আসানসোলের সেটে কন্যাপুরের ঘটনা। লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলছিল সে দিন। বছর আটত্রিশের তৃণমূল কর্মী অক্ষয় খুন হওয়ার পরে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, খুনে অভিযুক্তেরা ছিল ওই এলাকারই বাসিন্দা। খুনের ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষুব্ধ জনতা কয়েক জন অভিযুক্তের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একের পর এক জ্বলতে থাকে গাড়ি, মোটরবাইক, দোকান। গোটা গ্রাম যেন রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়।
বড় বাহিনী ও র্যাফ নিয়ে গ্রামে যান পুলিশের বড় কর্তারা থেকে নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকেরা। পরিস্থিতি তখন সামাল দেওয়া গেলেও এই ঘটনার পরে কয়েক দিনের জন্য গ্রামে যেন নেমে এসেছিল শ্মশানের নীরবতা। নিহতের পরিবারের তরফে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা হয়। মাস কয়েক পরে কেশব মণ্ডল, উজ্জ্বল মণ্ডল ও মিখাইল শেখ নামে তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মাস দেড়েক জেল হেফাজতে থাকার পরে জামিন পায় তারা।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনার চার্জশিট আদালতে সময় মতোই পেশ করা হয়েছিল। তবে বিচার প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। এই সাত বছরের মধ্যে পুরসভা, বিধানসভা ও লোকসভা মিলিয়ে আরও চারটি ভোট পেরিয়ে গিয়েছে। দোড়গোড়ায় আরও একটি ভোট। কিন্তু অক্ষয় বাউড়ি হত্যা মামলায় এখনও কেউ সাজা পায়নি বলে আক্ষেপ করেন নিহতের পরিবার থেকে পড়শিরা। আদালতে এখনও এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। গত সাত বছরে নানা কাজে অনেক নেতা এসেছেন এই গ্রামে। নিহতের স্ত্রী সন্ধ্যা বাউড়ি বলেন, ‘‘প্রত্যেকের কাছে মামলার শুনানি শুরু করার আবেদন জানিয়েছি। সকলেই আশ্বস দিয়েছেন। কিন্তু কোনও ফল হয়নি।’’ একই অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। প্রতিবেশী সুজন সুত্রধরের দাবি, অভিযুক্তদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শাস্তির ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
ঘটনার পরে তৃণমূল দাবি করেছিল, অক্ষয় ওই বুথে তাদের এজেন্ট ছিলেন। এলাকার কাউন্সিলর তথা তৃণমূল নেত্রী শ্রাবণী মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরাও শুনানি শুরু করার তদ্বির করছি।’’ আসানসোল পুরসভায় নিহতের স্ত্রী অস্থায়ী স্বাস্থ্যকর্মী পদে নিযুক্ত হয়েছেন। মাস মাইনে ২৭০০ টাকা। সন্ধ্যাদেবী জানান, সেই টাকাতেই টেনেহিঁচড়ে কোনও রকমে সংসার চলছে। বছরখানেক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের মৃত্যুর পরে খুনিদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছিলেন অক্ষয়ের মা কমলা বাউড়ি। সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। বছর দুই আগে তিনি মারা গিয়েছেন। গ্রামের এক চিলতে মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে আক্ষেপ ঝরে পড়ে সন্ধ্যাদেবীর গলায়। কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বলেন, ‘‘খুনিরা বুক ফুলিয়ে গ্রামে ঘুরছে। দেখে মন খারাপ হয়ে যায়! উপায় তো আর কিছু নেই!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy