দেড় মাস বাদেই অবসর। কিন্তু অবসর নেওয়ার ফুরসত নেই মাস্টারমশাইয়ের। মাথায় সাদা পানামা হ্যাট (সিপিএমে যা প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর টুপি বলেই পরিচিত), টেরিকটের হাফ-হাতা শার্ট, আর প্যান্ট। সঙ্গে মোজা ছাড়া স্নিকার্স। এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম দৌড়ে বেড়াচ্ছেন।
ভাতারের বাউড়িপাড়া ছেড়ে পালাড় গ্রামে ঢুকছেন বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে সিপিএমের প্রার্থী সাইদুল হক। পিচের রাস্তা ছেড়ে মোরাম-পথে হনহন করে এগিয়ে চলেছেন। তাল রাখতে না পেরে দলের মিছিল প্রায় পাঁচশো ফুট পিছনে। প্রার্থী হেসে বলছেন, “আমার তো গাড়ি চড়ার অভ্যেস নেই। সাংসদ হওয়ার পরেও আমি বাসে-ট্রেনেই ঘুরে বেড়িয়েছি।”
পালাড়ের গ্রামে এক উঠোনে প্লাস্টিকের ত্রিপল পেতে প্রচার। রাজ কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক সহজ করে গ্রামের ভাষায় বলছেন রাজনীতির কথা, “এটা দিল্লির সরকার গড়ার ভোট। ওখানে জমির আন্দোলন, ন্যায়-বিচার, মজুরির জন্য আন্দোলন আমরাই করেছি।” তবে তার চেয়েও বেশি বার বলছেন, “সব জায়গায় আমরা রুখে দাঁড়াচ্ছি। এ বার অন্য রকম ভোট।” একদম পিছনে গাছের ছায়ায় বসে ছিলেন হারাধন পাত্র। খালি গা, লুঙ্গি হাঁটুর উপরে খাটো করে বাঁধা। বিড়িতে টান দিতে দিতে বলে উঠলেন, “পঞ্চায়েতে তো ওরা এসে বলে গেল, ‘কাকা তোমাকে যেতে হবে না। ভোট পড়ে গিয়েছে’। তোমাদের তো কাউকেই তখন পাইনি। একা গিয়ে কি মার খাব!”
বিব্রত সাইদুল। এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বৃদ্ধকে অভয় দেন, “এ বার আমরা ময়দান ছাড়ব না। নির্বাচন কমিশন আছে। ভয় পাবেন না।”
বর্ধমানের মতো সিপিএমের একসময়ের ‘লেনিনগ্রাদ’-এ কি না শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনই বল-ভরসা? “না, না তা কেন”, প্রতিবাদ করেন জেলা সম্পাদক অমল হালদার। তা হলে পুর-ভোটে মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানো সিপিএম এখন কীসে বুকে বল পেল? অমলবাবু বলেন, “পঞ্চায়েতে ১৫টা গণনাকেন্দ্র, ১,০৮৯টা বুথ দখল করে নিয়েছিল তৃণমূল। আমাদের সাড়ে আট হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তখন পরিস্থিতি অন্য রকম ছিল। পুর-ভোটেও তো ভোটই হয়নি।” তাঁর দাবি, “অবস্থা বদলেছে। তৃণমূলের জনপ্রিয়তা কমছে। ওদের দলে ধস নামায় এখন সেই দৌরাত্ম্যও কমেছে। আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াইয়ে থাকব।” তাঁর সংযোজন, “কমিশনের প্রতি আস্থা আছে। তাদের পদক্ষেপ দেখে আস্থা আরও বাড়ছে।”
রিগিংয়ের অভিযোগ নিয়ে মাথাই ঘামাচ্ছেন না ‘মমতা’য় বলীয়ান মমতাজ সঙ্ঘমিতা। যিনি আবার একদা সাইদুলদেরই নেতা প্রয়াত মনসুর হবিবুল্লাহর মেয়ে। “মমতার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে প্রগতি শুরু হয়েছে। রাজ্যের ন্যায্য পাওনার দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। এ সব আমাকে আকৃষ্ট করেছে” বলছেন সাতষট্টি বছরের চিকিৎসক। তবে দৌড়তে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠছেন। বেশির ভাগ সময়েই তাই পছন্দ হুড-খোলা জিপ। বলছেন, “বিরাট কেন্দ্র। ১৫০ কিলোমিটার লম্বা আর ৭০ কিলোমিটার চওড়া। হেঁটে ঘোরা কি চাট্টিখানি কথা!”
মোদী-বলে উজ্জীবিত দেবশ্রী চৌধুরী কিন্তু বলছেন, “আমি তো এর মধ্যেই অন্তত তিনশো কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছি। তার উপরে খোলা জিপে ‘ম্যারাথন র্যালি’-ও করছি।” বছর বিয়াল্লিশের পোড়খাওয়া আরএসএস দেবশ্রী চার প্রার্থীর মধ্যে কনিষ্ঠতম। প্রবীণদের উদ্দেশে বলেন, “শিক্ষক শিক্ষকতা করবেন। ডাক্তার রোগী দেখবেন। আমি রাজনীতিক, রাজনীতি করব।”
বর্ধমানের বামপন্থী ইতিহাসে কোঙার পরিবারের পরেই বোধহয় নাম উঠে আসে ওঠে মনসুর হবিবুল্লাহ, শাহিদুল্লাহদের পরিবারের। খিলাফৎ আন্দোলন থেকে বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ওই পরিবারে। এক সময়ে সিপিএম প্রার্থী সাইদুল হকেরও নেতা ছিলেন বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রয়াত হবিবুল্লাহ সাহেব। বর্ধমানে সে ভাবে পরিচিত না হলেও, হবিবুল্লাহর মেয়ে মমতাজকে প্রার্থী করে চাল দিয়েছেন মমতা। তবে শহরের চেয়ে হবিবুল্লাহ সাহেবদের জনপ্রিয়তা গ্রামীণ বর্ধমানেই বেশি। তা হলে কি বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের চেয়ে মমতাজ বর্ধমান-পূর্ব কেন্দ্রেই স্বচ্ছন্দ হতেন বেশি? মমতাজ অবশ্য সে সব মানছেন না। বলেন, “আমি সব জায়গাতেই সমান স্বচ্ছন্দ।”
বর্ধমানে শহরের পারকাস রোডে সিপিএমের পেল্লায় জেলা অফিস হবিবুল্লাহদের পরিবারের জমিতেই তৈরি। তিন ভাই সিপিএমকে জমি লিখে দিলেও হবিবুল্লাহর মেয়ে মমতাজ দেননি। তাঁর ভাগের জমি ছেড়ে রেখে বাকি তিন ভাগে জেলা অফিস তৈরি হয়েছে। যে প্রসঙ্গ উত্থাপন হলে আরও বিব্রত দু’পক্ষ। সাইদুল শুধু বলছেন, “হবিবুল্লাহ সাহেব বেঁচে থাকলে খুব কষ্ট পেতেন।” জমি-বিতর্ক এড়িয়ে যাচ্ছেন মমতাজও। তাঁর যুক্তি, “আমি আসলে ওখানে আমাদের পরিবারের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে একটি জাদুঘর করব ভেবেছিলাম। জমি না দেওয়ার অন্য কারণ ছিল না।”
মমতাজের তা-ও পারিবারিক পরিচিতি আছে। দেবশ্রীর নেই। উত্তরবঙ্গের বালুরঘাটের মেয়ে। তাতে অবশ্য ‘ডোন্ট কেয়ার’ দেবশ্রীর। ফিক করে হেসে বলেন, “ভালই তো। উত্তরবঙ্গে জন্ম, কলকাতায় কর্ম, এ বার রাঢ়বঙ্গের প্রার্থী।” আরও জুড়ছেন, “বর্ধমান যখন যার অনুগত হয়েছে, তাকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। প্রথমে নবাবদের, পরে ইংরেজদের। স্বাধীনতার পরে প্রথমে কংগ্রেস, তার পরে একে-একে সিপিএম-তৃণমূল। এ বার বিজেপি-র পালা। এখানে পদ্মফুলের ঝড় উঠবে।” দেবশ্রীর কাছে এ বারের লড়াই খানিকটা বদলারও। বলেন, “এর আগে তৃণমূলের সঙ্গে জোটে থাকার সময়ে বিশ্বনাথ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলাম। তৃণমূল সাবোতাজ করে হারিয়ে দিয়েছিল। এ বার তার জবাব দেব।”
শিল্পপতি বিপিন ভোরা প্রার্থী হতে অস্বীকার করার পরে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে প্রথম রাউন্ডে খানিকটা ব্যাকফুটে কংগ্রেস। কোনও রকমে শেষ বেলায় প্রার্থী করা হয়েছে দু’-দু’টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মালিক বছর পঁয়ষট্টির প্রদীপ অগস্তি-কে। হাতে ন’টা আংটি। বললেন, “স্যুটকেসে আরও ছ’টা রাখা আছে। গলায় দেখুন, শনি আর মা লক্ষ্মীর মাদুলি। তার সঙ্গে একমুখী রুদ্রাক্ষ। সব স্টার আমার হাতের মুঠোয়। দেখে নেবেন, জিতবই।” নিজেকে কংগ্রেস প্রমাণে মরিয়া। ঘরের কোণে টাঙানো গ্রুপ ফটো দেখিয়ে বলেন, “ওখানে দেখুন কে নেই! যাদবেন্দ্র পাঁজা, আমার বাবা প্রশান্ত অগস্তি, মনোরঞ্জন বক্সী, কানাইলাল দাস, গোপাল মিশ্র। জেলার সব তাবড় পুরনো কংগ্রেস নেতা। বাবা কংগ্রেস আমলে কাঁকসা ব্লকের ইউনিয়ন বোর্ডের সভাপতিও ছিলেন।”
সিপিএম অবশ্য বলছে, কংগ্রেস ময়দান ছেড়ে দিয়েছে। তীব্র প্রতিবাদ প্রদীপবাবুর, “আমার দুর্ভাগ্য। চার দিকে সাড়া পড়ে গিয়েছে। তৃণমূল তো আমার চেয়েও কম ভোট পাবে। লড়াই তো সিপিএমের সঙ্গে।” এ সব শুনে হাসেন দুর্গাপুরের মেয়র-বিধায়ক এবং মমতার সেনাপতি অপূর্ব মুখোপাধ্যায়। বলেন, “পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ থেকে পুরসভা সব জায়গায় তো আমরাই ক্ষমতায়। এর পরে কি আর জেতা নিয়ে সন্দেহ থাকে!”
সন্দেহ আলবৎ আছে, বলছেন তৃণমূলের তৃণমূল স্তরের কর্মীরাই। অনেকের মতে, বর্ধমান-দুর্গাপুর থেকে কি আর প্রার্থী ছিল না! যাঁরা এত দিন সিপিএমের হাতে মার খেলেন, তাঁরা নন, প্রার্থী হলেন কি না, মমতাজ! অপূর্ববাবু মুচকি হাসেন, “আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর রাখি না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy