Advertisement
E-Paper

সেঞ্চুরির দুয়ারে যাত্রা শেষ ছোটরেলের

শতায়ু হওয়া আর হল না। তার আগেই থমকে গেল কাটোয়া-বলগোনা ছোট রেল। শেষ দিনে স্মৃতির এ যাত্রার শরিক হতে ভিড় করেছিলেন বহু মানুষ। পুরনো ইতিহাস তো মনে পড়লই, নানা স্টেশনে, ট্রেনের কামরায় তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় খোঁজ মিলল বহু হারিয়ে যাওয়া গল্পেরও। ম্যাকলিওড কোম্পানির আমলে এ লাইনের কর্মী ছিলেন কাটোয়া শহরের কাছারি পাড়ার বাসিন্দা অমরকুমার মৈত্র।

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০৭

শতায়ু হওয়া আর হল না। তার আগেই থমকে গেল কাটোয়া-বলগোনা ছোট রেল।

শেষ দিনে স্মৃতির এ যাত্রার শরিক হতে ভিড় করেছিলেন বহু মানুষ। পুরনো ইতিহাস তো মনে পড়লই, নানা স্টেশনে, ট্রেনের কামরায় তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় খোঁজ মিলল বহু হারিয়ে যাওয়া গল্পেরও।

ম্যাকলিওড কোম্পানির আমলে এ লাইনের কর্মী ছিলেন কাটোয়া শহরের কাছারি পাড়ার বাসিন্দা অমরকুমার মৈত্র। রবিবার বৈঠকি মেজাজে বললেন, “আমি একটি স্টেশনে কাজ করতাম। একদিন তিনজন নকশালকে বর্ধমান থেকে এই ট্রেনে তুলে কাটোয়া নিয়ে আসছিল পুলিশ। হঠাৎ নকশালদের হামলা। ট্রেনের ভিতরেই তিনজন পুলিশকে মেরে ধৃতদের ছিনিয়ে নিয়ে গেল তারা।” শ্রীখণ্ড গ্রামের বিশিষ্ট চিকিৎসক শীতল বন্দ্যোপাধ্যায় আবার হাসতে হাসতে বলেন, “আমাদের গ্রামের এক জন আত্মহত্যা করবে বলে গাঙ্গুলিডাঙার কাছে লাইনের উপর শুয়েছিল। কিন্তু ট্রেন আসতে এতই দেরি করল যে সেই ছেলেটি বিরক্ত হয়ে আত্মহত্যা না করে বাড়ি ফিরে গেল।” তাঁর দাবি, “এটা গল্প কথা নয়, সত্যি ঘটনা।”

মাঠ-ঘাট পেরিয়ে ছোটরেল চলার এ ছবি আর দেখা যাবে না (উপরে)। রবিবার সেই অভিজ্ঞতার
শরিক হতে ভিড় উপচে পড়ল প্রতি স্টেশনে। কোথাও হল সাঁওতাল নাচ, কোথাও অন্য
অনুষ্ঠান। পুরনো স্মৃতি উসকে দিল ম্যাকলিওড কোম্পানির কর্তার
নামে নামাঙ্কিত ইঞ্জিনের ছবিও। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

শ্রীখণ্ড গ্রামেরই শতবর্ষ পেরোনো নিত্যানন্দ ঠাকুর ম্যাকলিওড লাইট রেলওয়েজ কোম্পানির উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। এ দিন তিনি জানান, এ লাইন দিয়ে কুমুদরঞ্জন মল্লিক, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরা যাতায়াত করতেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ও এই ট্রেনে চড়েছেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এই ট্রেনে ফেরি করেন গোবিন্দ দত্ত। এ দিন ছলছল চোখে বললেন, ‘স্টিম ইঞ্জিনের সময় প্রায় দিনই মাঝপথে কয়লা ফুরিয়ে যেত। তখন কাঠ ও অন্য জ্বালানি কুড়িয়ে এনে কোনওরকমে গাড়িটিকে কাটোয়া পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতাম।”

রবিবারও নানা স্টেশনে অনুষ্ঠান, সংবর্ধনা নিতে নিতে দুলকি চালেই চলছিল পূর্ব রেলের শেষ ন্যারোগেজ। তবে আক্ষেপ নয়, বরং রেলপথের বড় হওয়ার অপেক্ষা চোখে পড়ছিল মানুষের মধ্যে। ট্রেন একের পর এক স্টেশন পেরোচ্ছিল আর, শ’য়ে শ’য়ে তাকে দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন মানুষ। বিভিন্ন স্টেশনে যাত্রীদের চকোলেট, মিষ্টি খাওয়ান স্থানীয় বাসিন্দারা। নানা রকম বাদ্যি, শাঁখ ও উলুধ্বনিও চলছিল। বনকাপাশি স্টেশনে যাত্রীদের সাঁওতালি নাচ দেখানো হয়। কাটোয়া স্টেশনেও দিনভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। আবেগে ভেসে একবারের জন্য ট্রেনে চড়ার মিনতি করছিলেন এলাকার লোকজন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল গার্ডদের সাবধান করাও। তারমধ্যেই বিপত্তি ঘটে গেল। বলগোনা স্টেশন ছাড়ার পথে ‘ভ্যাকুম পাইপ’ ফেটে হাওয়া বের হতে থাকে। রেলকর্মীরা অবশ্য তা সারিয়ে ফেলেন।

এই রেলপথের বাকি অংশ (বলগনা-বর্ধমান) বছর দুয়েক আগেই ব্রডগেজ হয়ে গিয়েছে। ওই লাইন দিয়ে পাঁচজোড়া ট্রেনও যাতায়াত করে। রেলের কর্তাদের আশা, ২০১৬ সালের শেষে কিংবা ২০১৭ সালের শুরুতে এই ২৬ কিলোমিটার পথও ব্রডগেজ হয়ে যাবে। কাটোয়া-বলগোনা লাইনের জন্য এনটিপিসি রেলকে গত মার্চ মাসে ১১২ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকাও দিয়েছে।

একসময় রানিগঞ্জের কয়লাখনি থেকে বর্ধমান-ব্যান্ডেল হয়ে কয়লা আনতে হতো ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানিকে। এতে লোকসানই হতো তাদের। ফলে কয়লা আনার জন্য ‘শর্ট রুট’ হিসাবে বর্ধমান-কাটোয়ার মধ্যে লাইন তৈরির চিন্তাভাবনা করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু লাইনটি লাভজনক হবে না ভেবে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানি লাইন তৈরি করতে বা ট্রেন চালাতে আগ্রহী হয় না। সেই সময় লন্ডনের ম্যকলিওড অ্যান্ড রাসেল কোম্পানিকে বিনামূল্যে জমি দিয়ে রেললাইন পাতা ও ট্রেন চালানোর কথা বলেন ব্রিটিশ সরকার। প্রথমে মিটার গেজ লাইন পেতে ট্রেন চালানোর কথা ভাবলেও অর্থনৈতিক কারণে ওই কোম্পানি ন্যারোগেজ লাইন তৈরি করে ট্রেন চালাতে থাকে। ১৯১৩ সাল থেকে বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথের কাজ শুরু করে ওই কোম্পানি। ছোট রেল গবেষক সৗরশঙ্খ মাজি বলেন, “১৯১৭ সালের ৫ এপ্রিল কোম্পানির নাম বদল হয়। ম্যাকলিওড লাইট রেলওয়েজ কোম্পানির সঙ্গে ১০ বছর করে চুক্তি হয় ব্রিটিশ সরকারের।” ১৯৬৬ সালের ১ এপ্রিল লাইনটি অধিগ্রহণ করে ভারতীয় রেল। এ লাইন দিয়ে এক সময় ৬ জোড়া ট্রেন যাতায়াত করত। সেই সময় চার চাকার ৭টি বগি কামরা চলত (এখন ৮ চাকার চারটি কামরা)। ২২ সিটের ট্রেনে তখন প্রথম, দ্বিতীয় ও সাধারণ শ্রেণিও ছিল। পুরনো বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা যায়, গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি কিংবা ঝড়ে গাড়ি উল্টে যাওয়া লেগেই থাকত। এ সব দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন মারাও গিয়েছেন।

তবে ছোট লাইন উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্মৃতি মুছেও গেল। এ ট্রেনেই জন্মেছিলেন ৫৮ বছরের লম্বোদর হাজরা। রবিবার বলগোনা স্টেশনে দাঁড়িয়ে ভিজে গলায় বললেন, “নিগন ও কৈচর স্টেশনের মাঝে ট্রেনের ভেতরই আমার জন্ম হয়েছিল। এখন থেকে জন্মস্থান বলে আর কিছু রইল না।” রইল না চার কামরার ট্রেনের ঢিমেতালের দুলুনিও।

katwa rail soumen dutta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy