ভাসছে বীরভূম। ঝাড়খণ্ডে যদি বৃষ্টি আরও চলে, আরও জল ছাড়বে জলাধারগুলি। বাংলায় আরও খারাপ হবে পরিস্থিতি। ছবি: পিটিআই।
সে বার বৃষ্টি ছিল না, কিন্তু পাশের রাজ্য থেকে আসা জলে আচমকা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল বাংলার বিভিন্ন নদ-নদী। দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা করাল বন্যার গ্রাসে চলে গিয়েছিল।
২০০০ সালের সেই বন্যার পর তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ম্যানমেড ফ্লাড’। বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছেড়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। রাজ্যের তদানীন্তন শাসক বামেদের দিকেই আঙুল তুলেছিলেন। ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে অন্যতম বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল ‘ম্যানমেড’ বন্যার অভিযোগ।
এ বার গভীর নিম্নচাপের জেরে কয়েক দিন ধরে তুমুল বর্ষণ হয়েছে দক্ষিণবঙ্গে। শুধু কলকাতাতেই ২০০ মিলিমিটারের কাছাকাছি বৃষ্টি হয়েছে মাত্র তিন দিনে। বাংলায় বৃষ্টি ধরে আসার পরও ঝাড়খণ্ডে অঝোর বর্ষণ জারি। ফলে মাইথন, পাঞ্চেত, তিলাইয়া, চান্ডিল, গালুডি-সহ বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছাড়া শুরু হয়েছে। ডুবতে শুরু করেছে হুগলি, হাওড়া, দুই মেদিনীপুর, বর্ধমানের বিভিন্ন অঞ্চল। বাঁকুড়া, বীরভূমের নানা এলাকা জলমগ্ন। পুরুলিয়ায় জলাধার উপচে বইছে জল।
২০১৭ সালের এই সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘রাজ্যে এখনও বন্যা পরিস্থিতি হয়নি। আমরা সব দিকে নজর রাখছি। ঝাড়খণ্ড আমাদের না-জানিয়ে জল ছেড়েছে। এ ভাবে বৃষ্টি চললে সমস্যা হবে।’’ অর্থাৎ, অভিযোগের আঙুল পাশের রাজ্যের সরকারের দিকে। আঙুল খানিকটা কেন্দ্রের দিকেও। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে কেন্দ্রের দিকে সরাসরি আঙুল না তুললেও, তাঁর সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঙুল কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন’-এর (ডিভিসি) দিকেই। সেচমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘ডিভিসি-কে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনও ভাবেই বাড়তি জল ছাড়া যাবে না। দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদেরও দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।’’
সতীঘাট, বাঁকুড়া। ঝাড়খণ্ড থেকে আসা জলে ফুঁসতে শুরু করেছে গন্ধেশ্বরী। ছবি: পিটিআই।
এখানেই প্রশ্ন তুলছে বিরোধী দলগুলি। বাম জমানাতেও প্রতিবেশী রাজ্য থেকে আসা জলেই বাংলা ভেসেছিল। বাংলায় সে বার খুব বেশি বৃষ্টি হয়নি ঠিকই, কিন্তু ঝাড়খণ্ডে প্রবল বর্ষণের জেরে বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছাড়তে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা বানভাসি হয়েছিল। ঝাড়খণ্ডে এবং ভুটানে বৃষ্টি বেশি হলে তার প্রভাব বাংলায় চিরকালই পড়ে। কারণ ঝাড়খণ্ড এবং ভুটান থেকে আসা জল বাংলা হয়েই সমুদ্রের দিকে যায়। কিন্তু ২০০০ সালে সেই প্রাকৃতিক কারণটিকে গুরুত্ব দিতে চাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের উপরেই দায় চাপিয়েছিলেন। এ বার তাঁর নিজের জমানায় যখন পাশের রাজ্যের বিভিন্ন জলাধার থেকে জল ছাড়া হচ্ছে এবং তার জেরে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ছে, তখন দায় নিজের মাথায় কেন নেবেন না মমতা? কেন ঝাড়খণ্ড সরকারের দিকে এবং কেন্দ্রের দিকে আঙুল তুলবেন? প্রশ্ন বামেদের।
রাজ্যের বামফ্রন্ট পরিষদীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, ‘‘চিরকালই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতি করেন। শুধু ২০০০ সালের ম্যানমেড ফ্লাড সংক্রান্ত মন্তব্য নয়। তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দৃষ্টান্ত আরও আছে। আয়লায় যখন সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হল, বহু নদীবাঁধ ভেঙে গেল, তখনও রাজ্য সরকারের সঙ্গে তিনি অসহযোগিতা করেছিলেন। বাঁধ তৈরির জন্য কেন্দ্র যাতে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে টাকা না দেয়, তার জন্য ওঁর দলের সাংসদ কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি লিখেছিলেন।’’
এ বারের পরিস্থিতি সম্পর্কে তা হলে সুজনবাবুদের মতামত কী? এই পরিস্থিতিকে কি তাঁরা ম্যানমেড বলবেন? সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য: ‘‘চাইলে ম্যানমেড বলতেই পারতাম। রাজ্য সরকারের দিকে আঙুল তুলতেই পারতাম। কিন্তু আমরা কোনও দিনই এই রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতি করি না।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সুজন চক্রবর্তীদের বার্তা, ‘‘দায়িত্বশীল হওয়ার আগ্রহ যদি থাকে, তা হলে ২০০০ সালে যে মন্তব্য করেছিলেন এখনই তা প্রত্যাহার করুন।’’
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল। ফি বছরই ভাসে শাীলাবতীর তীরবর্তী এই মফস্সল শহর। ঝাড়খণ্ড থেকে জল এলেও ভাসে, না এলেও ভাসে। দায় কার? দশকের পর দশক ধরে উত্তর খুঁজছেন ঘাটালবাসী। ছবি: পিটিআই।
বামেরা যেমন চায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আগের মন্তব্য প্রত্যাহার করুন, ঠিক তেমন ভাবেই ঝাড়খণ্ডের সরকার চায়, বাংলার সরকার এ বারের মন্তব্য প্রত্যাহার করুক। সোমবারই ঝাড়খণ্ডের সেচমন্ত্রী চন্দ্রপ্রকাশ চৌধুরী বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গকে না জানিয়ে জল ছাড়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। ঝাড়খণ্ডের কোনও বাঁধ থেকে জল ছাড়া হলে সঙ্গে সঙ্গেই তা বাঁধ সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির প্রশাসনকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এ বারেও তা করা হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: সীমানা-পারের জলের ঢল বান ডাকছে বাংলায়
চন্দ্রপ্রকাশ চৌধুরীর এই দাবি কিন্তু ভিত্তিহীন নয়। ঝাড়খণ্ডের কোন বাঁধ থেকে কখন কত জল ছাড়া হবে, তা ঠিক করে ‘দামোদর ভ্যালি রিভার রেগুলেটরি কমিশন’। ঝাড়খণ্ডের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিনিধিরাও তাতে রয়েছেন। সবাইকে জানিয়েই পদক্ষেপ করা হয়। কতটা জল ছাড়া হবে, কোন পথ দিয়ে সেই জল যাবে, কোন কোন এলাকা প্রভাবিত হতে পারে, সবই আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলার সেচমন্ত্রী অবশ্য সে কথা মানতে নারাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy