Advertisement
E-Paper

তৃণমূলের চাপে রক্তদান এ বার হাড়কাটা গলিতে

ব্যবধান মাত্র পাঁচ দিনের। সোনাগাছির পর রক্তদান শিবির এ বার শহরের আর এক যৌনপল্লি, বৌবাজারের হাড়কাটা গলি চত্বরে! নেপথ্যে ফের শাসক দল তৃণমূল। সোনাগাছির শিবিরে হাজির ছিলেন রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী, পেশায় চিকিৎসক শশী পাঁজা। আর বৃহস্পতিবার হাড়কাটা গলি চত্বরের শিবিরে উপস্থিত থেকেছেন তৃণমূল সাংসদ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৫ ০৩:২৬

ব্যবধান মাত্র পাঁচ দিনের। সোনাগাছির পর রক্তদান শিবির এ বার শহরের আর এক যৌনপল্লি, বৌবাজারের হাড়কাটা গলি চত্বরে!

নেপথ্যে ফের শাসক দল তৃণমূল। সোনাগাছির শিবিরে হাজির ছিলেন রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী, পেশায় চিকিৎসক শশী পাঁজা। আর বৃহস্পতিবার হাড়কাটা গলি চত্বরের শিবিরে উপস্থিত থেকেছেন তৃণমূল সাংসদ এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সুদীপবাবু ছাড়াও এ দিনের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়, ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অপরাজিতা দাশগুপ্ত, ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সঞ্চিতা মণ্ডল, স্থানীয় কাউন্সিলর সত্যেন্দ্রনাথ দে-র মতো তৃণমূলের নেতানেত্রীরা। সোনাগাছিতে রক্তদান শিবির করা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সমস্ত মহলে। কিন্তু শাসক দল যে তাতে থোড়াই কেয়ার করছে, বৃহস্পতিবারের শিবির তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বলেই অনেকে মনে করছেন। আগের রক্তদান শিবিরের মতো এ দিনও রক্তদানের বিনিময়ে উপহারের বন্দোবস্ত ছিল। সরকারি সূত্রের খবর, মোট ১৫০ জন রক্ত দিয়েছেন। প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে নামী সংস্থার জলের ফিল্টার।

নিয়ম অনুযায়ী, কোনও যৌনপল্লির ভিতরে বা তার দুই কিলোমিটারের মধ্যে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা নিষিদ্ধ। একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলে এইচআইভি বা অন্য নানা ধরনের যৌন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় বলেই এই ধরনের সতর্কতাবিধি চালু করেছে কেন্দ্রীয় রক্ত সঞ্চালন পর্ষদ। শুধু যৌনকর্মীদের কাছ থেকেই নয়, যাঁরা নিয়মিত মাদক সেবন করেন, ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক নেন, তাঁদের শরীর থেকেও রক্ত নেওয়া নিষিদ্ধ।

সোনাগাছির ঘটনা নিয়ে তোলপাড়ের পরেও চিকিৎসকরা কেন আপত্তি তুললেন না? মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসক সাফ বলে দিচ্ছেন, ‘‘পুরোপুরি রাজনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছি আমরা। কোনও বিষয়ে ‘না’ বলার উপায় নেই। এখানে শিবির করার ব্যাপারে আপত্তি তুললে মার খেতে হতো।’’

গত বার সোনাগাছির শিবিরের রক্ত গিয়েছিল মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে। আর এ দিনের শিবির থেকে সংগৃহীত রক্ত গিয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। একমাত্র কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই ‘ইমিউনো হেমাটোলজি অ্যান্ড ব্লাড ট্রান্সফিউশন’ বিভাগটি রয়েছে, যেখানে স্নাতকোত্তর স্তরে পঠনপাঠন হয়। ব্লাড ব্যাঙ্কটিও সেই বিভাগের সঙ্গেই সংযুক্ত। কী ভাবে এমন একটি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা এই ধরনের শিবিরে অনুমতি দিলেন? বিভাগীয় প্রধান কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কী আর বলব? আমাদের হাসপাতাল থেকে আরএমও, ইন্টার্নরা যাচ্ছেন। রক্ত নিয়ে আসছেন। এর পর রক্তের স্ক্রিনিং হলে যদি কোনও সংক্রমণ ধরা পড়ে, তা হলে ফেলে দেব।’’ কিন্তু ‘উইন্ডো পিরিয়ড’-এ (সংক্রমণের পরে দু’সপ্তাহ থেকে ছ’মাস) তো সংক্রমণ ধরা পড়বে না, সে ক্ষেত্রে কী হবে? কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তাঁর জবাব, ‘‘আমার কিছু বলার নেই। আপনারা সবই জানেন।’’

বৃহস্পতিবার হাড়কাটা গলি চত্বরের ওই ক্যাম্পে বসে মেডিক্যালের ব্লাড ব্যাঙ্কের এক কর্মী আনন্দবাজারকে ফোনে বলেছেন, ‘‘বুঝতে পারছেন কতটা অসহায় হলে এই ধরনের কাজ আমাদের করতে হয়।’’ সাধারণ মানুষকে এতটা ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে কেন বারবার বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা? প্রশ্নের অস্বস্তি এড়াতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কটির অধিকর্তা বিশ্বজিৎ হালদার বলেন, ‘‘আমি ছুটিতে আছি। তাই বিষয়টি জানতাম না।’’ যদিও এ দিন বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালে নিজের বিভাগেই বসে থাকতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।

বিশ্বজিৎবাবু কিছু না বললেও ওই বিভাগের অন্য চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ওই এলাকায় রক্তদান শিবির করার ব্যাপারে শুরু থেকেই আপত্তি ছিল। কিন্তু স্থানীয় যে সংগঠনের বকলমে ওই শিবিরের আয়োজন, সেই ‘যাত্রিক’ ক্লাবের সদস্যরা স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ‘‘যে ভাবেই হোক শিবির ওখানেই হবে। এটা আমাদের সম্মানের ব্যাপার। সুদীপদা (সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়) আসছেন। ওঁকে কথা দেওয়া আছে।’’

কী বলছেন সুদীপবাবু? তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওটা হাড়কাটা গলি নয়। ওটা তো নবীনচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। সোনাগাছির বিষয়টা সত্যিই যৌনপল্লির ভিতরে ছিল। এটা তা নয়।’’ তাঁকে বলা হয়, দু’টি রাস্তা অর্থাৎ হাড়কাটা গলি বা প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট এবং নবীনচাঁদ বড়াল স্ট্রিট একেবারেই পাশাপাশি এবং দু’টি রাস্তাই এক জায়গায় মিলেছে। তা ছাড়া ন্যাশনাল এড্স কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (ন্যাকো)-র নির্দেশিকা অনুযায়ী, যৌনপল্লির দু’কিলোমিটারের মধ্যে এই ধরনের শিবির করা যায় না। এর পাল্টা সুদীপবাবু বলেন, ‘‘সব কিছুর মধ্যে অন্য অর্থ খোঁজার চেষ্টা করবেন না। আমি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলাম। আমি সব জানি। ন্যাকো-র নির্দেশিকা মেনে সব কিছু চলে না। তা ছাড়া যাঁরা রক্ত দিচ্ছেন তাঁদের দোষ নয়। তাঁদের অত কিছু জানার কথা নয়। যাঁরা নিতে আসছেন, এটা তাঁদের দায়িত্ব। তাঁরা কেন আপত্তি করেননি?’’

তাঁর এই মন্তব্যে স্তম্ভিত মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসকেরা। তাঁদের প্রতিক্রিয়া, ‘‘যাঁদের চাপে আমরা চিকিৎসক হয়েও নিয়মনীতি বিসর্জন দিচ্ছি, তাঁরা আবার আমাদের পাল্টা চাপ দিচ্ছেন!’’

খাতায়-কলমে রক্তদান শিবিরের ঠিকানা ছিল, ১০ নম্বর নবীনচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। সেই ঠিকানা খুঁজে পৌঁছে দেখা গেল, সেখানে তখন উৎসবের মেজাজ। ঠিক গা ঘেঁষেই হাড়কাটা গলি অর্থাৎ প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। দুই রাস্তার ঠিক মাঝখানেই রক্তদান শিবিরে আয়োজন করা হয়েছে। বাঁধা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। সেখানে তৃণমূলের সাংসদ ও অন্য নেতাদের জন্য সার সার চেয়ার পাতা। চার পাশে টাঙানো রয়েছে তৃণমূলের পতাকা। এক দিকে রক্ত নেওয়া হচ্ছে। আর তার অদূরেই রাস্তায় নেশা করে গড়াগড়ি দিচ্ছেন অনেকে। রক্তদান শিবিরের অদূরেই খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বসে ছিলেন কয়েক জন যুবক। চার পাশে মদের গন্ধ।

সব শুনে বিস্মিত রাজ্যের চিকিৎসক মহল। তাঁদের বক্তব্য, রক্ত থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর ঘটনা যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে রক্তদান শিবির আয়োজন করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্কতা বাঞ্ছনীয়। রক্তদান নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন যাঁরা, বীতশ্রদ্ধ তাঁরাও। রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের সদস্য একটি সংগঠনের তরফে অচিন্ত্যকুমার লাহা বলেন, ‘‘স্বেচ্ছায় রক্তদানের ধারণাটাকেই পুরোপুরি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে, কিছু উপহারের লোভে রক্ত দেওয়া চলছে। রক্ত সুরক্ষা বিষয়টাই আগাগোড়া শিকেয় উঠেছে।’’

Harkata gali Blood donation sudip bandapadhya Achintya Kumar Laha soma mukhapadhya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy