মঞ্চে বিশিষ্টদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রিওর রংবাহারি কার্নিভ্যালের সঙ্গে তুলনা টেনে ঘোষণা চলছিল শোভাযাত্রা শুরুর আগে থেকেই।
শুনে টান-টান ব্রাজিলকন্যা লরাউ। ইতালীয় বান্ধবী সিলভিয়া, জেনি, মাসেনজিয়াদের সামনে সগর্বে ময়ূর-ময়ূর ভঙ্গিতে একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিলেন। মাদার হাউসের স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কলকাতায় এসেছেন এক ঝাঁক তরুণী। বচ্ছরকার পার্বণের সময়টা কলকাতায় থাকতে পেরে বারবার নিজেদের কপালকেই ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন তাঁরা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোধহয় এটাই চেয়েছিলেন। ৩৯টি বাছাই পুজো কমিটির শোভাযাত্রা শেষে তিনিও তো বললেন, ‘‘রেড রোডে আজ ইতিহাস তৈরি হল। এটা এক দিন বিশ্বের বিগেস্ট পাবলিক কার্নিভ্যাল হবে। বাংলার আঙিনায় বিশ্ব আসবে।’’
ঘণ্টা দুয়েকের প্যাকেজে এ যেন মোটামুটি পাঁচ দিনের দুর্গোৎসবের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা। ঢাকের বাদ্যি, চলন্ত ট্রেলারে আরতি, ধুনুচি নাচ, সিঁদুরখেলা, জাতধর্ম নির্বিশেষে বাংলার রামধনু সমাজের গো অ্যাজ ইউ লাইক, ছো নাচ, সাঁওতালি নৃত্য— কিছুই বাদ পড়ল না। থিমের উপচারে কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি থেকে নগর-কীর্তন মজুত। অদিতি মুন্সীর কীর্তন ‘গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধূসূদন, গিরিধারী, গোপীনাথ, মদনমোহন’ শুনে মুখ্যমন্ত্রী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্ল, পূর্ণদাস বাউলরাই শুধু নন, বিদেশি অতিথিরাও তাল দিলেন।
কলকাতার জার্মান কনসাল-জেনারেল ওলাফ ইভেসেন বা ইতালীয় ডেপুটি কনসাল জেনারেল ভিনসেনজা বাফেলোর কাছে কলকাতার পুজো নতুন কিছু নয়। তা-ও হাঁ করে রঙের মিছিলটা গিলছিলেন তাঁরা।
আপনাদের দেশে না আমাদের এখানে, কোথায় বেশি জমজমাট হয় দুর্গাপুজো? বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার জকি আহাদকে প্রশ্ন করেছিলেন এক পরিচিত। স্ত্রী নামিয়া রহমান আহাদের সঙ্গে শোভাযাত্রা দেখার ফাঁকে হেসে বললেন, ‘‘আমাদের ওখানেও কিন্তু খুব ভাল হয় দুর্গাপুজো!’’
দুর্গাপুজো কী? খানিকটা হোমওয়ার্ক বেশি ব্রাজিলের মেয়ে লরাউয়েরই। মাকে নিয়ে মাদার হাউজের কাছে ক’টি মণ্ডপে ঘুরেছেন। মোবাইলে স্পেনের ইসা বেলা, আর্জেন্তিনার মারিয়াদের ছবি দেখাতে দেখাতে বললেন, ‘‘মেয়েদের কপালে এই লাল ছোপটা কিন্তু দেখতে বেশ!’’
পথ জুড়ে চলেছে শোভাযাত্রা।
ইতালীয় মহিলা সাবিনা ব্যস্ত টাটকা ছবি রোমে ছেলেকে হোয়াট্সঅ্যাপ করতে। আর এক ইতালীয় মেয়ে জেনিও যেন ভারত-বিশেষজ্ঞ। পিঠে ‘ওম’ লেখা ট্যাটু। বললেন, ‘‘দেবী ‘দুর্জা’র গপ্পোটা আমি দারুণ জানি!’’ ত্রিশূলধারী দুগ্গাকে দেখে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘উনিই তো শিব, তাই না? হাতে যে ট্রাইডেন্ট দেখছি!’’ হাওড়ার সাবেক প্রতিমা দেখে টোকিওর আয়ানো ও ফ্রান্সের ইভা ভাঙা ইংরেজিতে জানালেন, ‘দিস ইজ দ্য বেস্ট’।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মমতা নিজে বিদেশিদের ভিড়টাকে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। দেখে চিলির সেবাস্তিয়ানের কী হাসি, ‘‘শি ইজ দ্য চিফ মিনিস্টার! দেখেছো আমি কেমন বিখ্যাত লোক!’’
সদর স্ট্রিটে ঘাঁটি গাড়া শহরের এই বিদেশি অতিথিদের কার্নিভ্যাল দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন জনৈক হোটেল-কর্তা হরভিনদর সিংহ ওরফে হ্যারি। দেখা গেল, টালাপার্কের বুলা বসু বা টালিগঞ্জের জয়া চৌধুরীর মতো তাঁরাও প্রাণপণে পুজোর রং চেটেপুটে উপভোগ করলেন। বুলাদেবী বললেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতার অনেকগুলো পুজো এ বার দেখতে যেতে পারিনি। ভালই হল, এক সঙ্গে বসে সব দেখে নিলাম।’’
আহিরীটোলা সর্বজনীনের প্রতিমা স্থান পেল এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনে। শুক্রবার ছবিগুলি তুলেছেন
সুদীপ আচার্য, রণজিৎ নন্দী ও দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
বিশ্ববাংলা পুরস্কারপ্রাপ্ত পুজোগুলি তুলে ধরার সঙ্গে আগামী বছর থেকে আরও বড় করে কার্নিভ্যালের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, পরের বার ৭৫টি পুজোকে নিয়ে এই শোভাযাত্রা হবে। নগরোন্নয়ন এবং তথ্য সংস্কৃতি দফতরকেও মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, বিভিন্ন মণ্ডপের কিছু নিদর্শন যেন ইকো পার্কে সাজিয়ে রাখার ব্যবস্থা হয়। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘প্রতিমা ভাসান হলেও, মাকে কিন্তু আমরা আসলে বিসর্জন দিই না। মা আমাদের ঘরেই থাকেন।’’ পুজো শেষের এই রেশটুকুই শেষ কথা বলে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy