—ফাইল চিত্র।
মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে রাজ্যের নতুন শিক্ষা বিল পেশ স্থগিত হয়ে গেল। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপর বিধিনিষেধ আরোপের প্রস্তাব রয়েছে বিলটিতে। এই বিল নিয়ে বিরোধীদের মধ্যে তো বটেই, শাসক দলের অন্দরেও ক্ষোভ বাড়ছিল। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই মূল ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। পরিস্থিতি আঁচ করে সক্রিয় হলেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকার জানিয়ে দিল, আপাতত বিধানসভায় পেশ হচ্ছে না শিক্ষা বিল।
সরকারি চাকরি করলে সক্রিয় রাজনীতি করা যাবে না, এ বিধি গোটা দেশেই প্রচলিত। কিন্তু সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যাঁরা শিক্ষকতা করেন, তাঁরা এই বিধির বাইরেই ছিলেন। কারণ সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মূলত সরকারি ব্যয়ে চললেও শিক্ষক বা অধ্যাপকদের সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হিসেবে ধরা হয় না। শিক্ষাব্যবস্থা যাতে স্বাধীন ভাবে পরিচালিত হতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
বাংলার রাজনীতিতে দীর্ঘ দিন ধরেই শিক্ষক, অধ্যাপকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। বামপন্থী বা জাতীয়তাবাদী, বাংলার রাজনীতির দুই ধারাতেই শিক্ষকদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। বাম সরকারের আমলে অসীম দাশগুপ্ত, সত্যসাধন চক্রবর্তী, সুদর্শন রায়চৌধুরী, সৌমেন্দ্রনাথ বেরা, দেবেশ দাস, আবদুস সাত্তারের মতো অধ্যাপকেরা শুধু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করেননি, মন্ত্রীও হয়েছেন। তৃণমূলের সৌগত রায়, ব্রাত্য বসু, রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, জ্যোতির্ময় কর, সৌমেন মহাপাত্র-সহ অনেক মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক দীর্ঘ দিন শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন বা রয়েছেন। কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান, বিরোধী দলের উপনেতা নেপাল মাহাতো-সহ আরও অনেকে শিক্ষকতার আঙিনা থেকেই এসেছেন। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতিতে আসার উপর যদি নিষেধাজ্ঞা থাকত, এঁদের অনেকেই তা হলে রাজনীতিতে আসতে পারতেন না। শিক্ষা জগতের মানুষদের এ ভাবে রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হলে সামগ্রিক ভাবে রাজনীতিরই ক্ষতি, মনে করছেন অনেকেই। বিরোধী এবং শাসক, দু’পক্ষের বিধায়কদের মধ্যেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এই নতুন বিল নিয়ে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন: বরকতির বিরুদ্ধে পথে নেমে মার খেল বিজেপি
যে বিল পার্থ চট্টোপাধ্যায় পেশ করতে চেয়েছিলেন, তাতে বলা হচ্ছে, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপকরা চাইলেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে তাঁরা ভোটে লড়তে পারবেন। বিলের এই অংশকে প্রবল আপত্তিকর হিসেবে দেখছেন বিরোধীরা। কারণ এই রকম আইন তৈরি হলে শিক্ষক, অধ্যাপকদের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরও চেপে বসবে। যে শিক্ষক বা অধ্যাপকরা শাসক দলের সঙ্গে থাকবেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে যে নির্বাচনে লড়ার অনুমতি পাওয়ার আশা যে খুব কমে যাবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নতুন শিক্ষা বিল নিয়ে তাই ব্যাপক হইচই শুরু হয়। পার্থবাবু নিজেও তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান এবং বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীকে ডেকে আলাদা করে আলোচনা করেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, এই বিলে সকলের উপকারই হবে। কিন্তু ঠিক কী ভাবে এই বিল সকলের জন্যই উপকারী হয়ে উঠবে, তার কোনও স্পষ্ট যুক্তি নেই। স্বাভাবিক ভাবেই পার্থবাবুর কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। বিরোধীদের মতো শাসক দলের ভিতরেও অসন্তোষ ঘনিয়ে উঠতে শুরু করে। বিলটিকে আগে বিধানসভার সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবিও ওঠে।
এই পরিস্থিতিতেই শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী নিজে হস্তক্ষেপ করেছেন বলে সূত্রের খবর। এ দিনই শিক্ষা বিল বিধানসভায় পেশ হওয়ার কথা ছিল। মুখ্যমন্ত্রী তা স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে। সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, নতুন শিক্ষা বিল আপাতত বিধানসভায় বেশ হচ্ছে না। বিলটি নিয়ে আরও ভাবনা-চিন্তার পরই এগনো উচিত বলে মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, বিলের মূল খসড়া এবং ছাপার মধ্যে কিছু গরমিল রয়েছে। যে বিল ছেপে এসেছে, তার কয়েকটি শব্দ নিয়ে তাঁর নিজেরই আপত্তি রয়েছে বলে পার্থবাবু জানিয়েছেন। বিরোধীদের তরফ থেকে এই বিলের ২৪টি সংশোধনী জমা পড়েছে। এই সব কারণেই বিল এ দিন পেশ হয়নি বলে শিক্ষামন্ত্রীর দাবি। প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সহ বিলটি শীঘ্রই পেশ হবে, কিন্তু বিলের মূল কাঠামোয় কোনও পরিবর্তন হবে না বলে তিনি জানিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy